-মহম্মদ মহসীন
যুক্তিবাদী হওয়ার জন্য বি.এ, এম.এ পাশের খুব একটা প্রয়োজন পড়ে না। যাদের বাস্তব বোধ আছে তারাই হতে পারেন যুক্তিবাদী। যারা খোলা মনে অন্যের স্বার্থ নিয়ে চিন্তা করেন যুক্তিবাদী মানসিকতা গড়ে ওঠে তাদের মাঝে। বৈজ্ঞানিক মানসিকতা গঠনের জন্য বিজ্ঞান পড়তে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, বিজ্ঞানী হওয়ার তো কথাই আসে না। আমার জীবনের কয়েকটি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা আজ সকলের কাছে রাখতে চাই।
খুব ভোরে হাঁটা আমার বহু দিনের অভ্যাস। হেঁটে যেতাম বাড়ি থেকে দেড় কিমি দূরে রেল স্টেশনে। তার পাশে ধান জমি। অত ভোরেই একজন পাম্পসেট চালিয়ে সেচ দেবার যোগাড় যন্ত্র করছে। আমাকে দেখে ডাকলো। কৌতূহল নিয়ে কাছে গেলাম। “শুনেছেন কাল রাতে নরেনকে (নাম পরিবর্তিত) সাপে কেটেছে। আর তাকে নিয়ে চলেছে বজরং (নাম পরিবর্তিত) ওঝার কাছে। আমি তো রেগে মেগে হুলুস্থুল করলাম, শেষে ওঝাবাড়ি বাদ দিয়ে হাসপাতালে নিয়ে গেল। ইনজেকশন দিয়েছিল, আজ ভালো আছে। আরেকটু দেরী হলে কলকাতা নিয়ে যেতে হতো, ডায়ালিসিস করতে হতো, তাও বলা যায় না, কী যে হতো বলা যায় না। ”
এই কৃষকটি প্রায় আশি ছুঁই-ছুঁই। জীবনে স্কুলের মুখ তো দেখেই নি। আর মুক্তমনা-যুক্তিবাদী এসব কথাও শোনে নি। কিন্তু তার মানসিকতা বৈজ্ঞানিক। অভিজ্ঞতার নিরিখে সে বুঝেছে, ওঝা নয়, সাপে কাটলে হাসপাতাল যেতে হয়। আমি অবাকই হয়েছিলাম। কারণ এখন অনেক ডিগ্রীওয়ালা শিক্ষিতকেও ওঝাবাড়ির শরণাপন্ন হতে দেখি আকছার। গ্রামের কিছু ছেলেমেয়ে পড়তে আসে। মাঝে মাঝে কথার পিঠে কথায় তাদের যুক্তিবাদের বহিঃ প্রকাশ দেখতে পাই। ধর্ম প্রসঙ্গ আসে, বলি তোরা জানিস কোরাণ কে লিখেছে? একবাক্যে সবাই বলে মোহাম্মদ লিখেছে। অথচ তাবৎ বিশ্বের মুসলমানে বিশ্বাস করে ওটা মোহাম্মদ নয় স্বয়ং আল্লাহর রচনা। এই জলজ্যান্ত অবাস্তব কথাটি বিনাপ্রশ্নে মেনে নেয়। হায়! একটা নাইন টেনের ছেলে-মেয়ের বোধ বুদ্ধিও যদি তাদের থাকতো!
এক রেডিও মিস্ত্রি অর্শের যন্ত্রণায় ভুগছেন। তিনি দৈব, টোটকা এবং গাঁয়ে ঘরের আয়ুর্বেদ চিকিৎসা করান। রক্তপাত হয়ে হয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছেন। তার কথা, অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি, পাঁচশ' টাকা ফি দিয়ে হাজার হাজার টাকার ওষুধ খেয়ে শেষ হয়ে গেছি। আর খরচায় কুলিয়ে উঠতে পারছি না। ও আমার টোটকাই ভালো। তাতেও উপশম পাই না, সরকারী হাসপাতালে তো করোনা ছাড়া কারুর গুরুত্ব নেই। শুনছি জানুয়ারীতে ইমামবাড়া হাসপাতালে এক ডাক্তার আসছে, তাকেই দেখাবো। করোনা নাহলে ওয়ালসে অপারেশন হয়ে যেত।
-তবে এখন যে দৈব খাচ্ছি, তাতে ভালো হয়ে যাবে বলছে।
-ভালো হবে বলে কিছু বুঝছেন?
-এখন পর্যন্ত কোনো উপকার হয় নি, তবে যে আমাকে সন্ধান দিয়েছে তার ভালো হয়ে গেছে।
আধুনিক চিকিৎসার সুযোগ না পাওয়াটাও দৈব, টোটিকা, আয়ুর্বেদ, হোমিওপ্যাথি করার অন্যতম কারণ। স্বাস্থ্য বিষয়ে সরকারী উদ্যোগ যথেষ্ট হলে, ঘরে ঘরে আধুনিক চিকিৎসা পৌঁছে দিতে পারলে এইসব অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসার রমরমা অনেকটাই কমে যেত। গ্রামের এক যুবক সর্পদষ্ট হয়। ওঝার বাড়িতে মরতে বসেছিল, কয়েকজন জানতে পারি। ধরে বেঁধে এন আর এস এ নিয়ে যাওয়া হয়। গিয়ে বেশ কয়েকবার ডায়ালিসিস করে এখন পুরো সুস্থ। কিন্তু রাস্তার ধারে একটি গাছের তলায় পাকা বেদী বানিয়ে নিয়মিত মনসা পুজো করে। তবে একটা কাজ সে করে, কাউকে কোনো সাপ মারতে দেয় না। আমার আরেক আত্মীয়কে সাপে কাটলে চুঁচুঁড়া ইমামবাড়া হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে দেখি আরেক আত্মীয় জলপড়া নিয়ে গেছে। অর্থাৎ আধুনিক চিকিৎসার সাথে সাথে দৈবও চালাচ্ছে। প্রতিটি হাসপাতালেই দেখবেন একটা করে ধর্মস্থান তৈরী করে রেখেছে, আয়ও তার চোখ টাটানোর পক্ষে যথেষ্ট।
অন্যরকম যুক্তিবাদী মনের অশিক্ষিত, স্বল্প-শিক্ষিত লোককেও দেখেছি। আমাদের রেল স্টেশনে আছে একটি চায়ের দোকান। নীলমাধব। মাধ্যমিক দিয়েছে কি না জানি না। তবে একটা কাব্যিক দৃষ্টিভঙ্গী আছে, তাই দোকানের সাইন বোর্ড বেশ লম্বা। তাতে লিখেছেঃ নীল আকাশের নীচে, নীল মাধবের চা। একদিন সকালে দোকানের পাশ দিয়ে যাচ্ছি। গান বাজছিল-
"শত জনমের কত সাধনায়
পেয়েছি এ মানব প্রাণ,
ওগো ভগবান ওগো দয়াময়
আমি যে তোমারি দান"।
শুনলাম নীলমাধব তর্ক করছে, জন্মান্তর বলে কিছু হয় না। তাই অন্য জন্মের পূণ্যফলে মানব জন্ম হয়, এ মানা যায় না, এটা ঠিক নয়। তাছাড়া, জন্ম জন্মান্তরের সাধনায় যদি মানব জনম পাই, তাহলে আগের জন্মে নিশ্চয়ই মানব জনম পাই নি। আগে কি গরু ছাগল হয়ে সাধনা করছিলাম? সাধনা তো মানুষেই করে। তো আগের জন্মেই যদি মানুষ হয়েই সাধনা করে থাকি, তাহলে এ মানব জনম ভগবানের দান হয় কিভাবে? পাশ দিয়ে যেতে যেতে শুনছিলাম আর ভাবছিলাম, এমন প্রশ্ন আর কেউ করে না কেন? অনেক ধর্মান্ধ লোকের মাঝেও মানুষের গুণ দেখেছি। এক সব্জি বিক্রেতা দেখা হলেই আমার শরীর ভালো আছে কি না, বাড়ির সকলে কে কেমন আছে, জিজ্ঞাসা করে। আমাকে শুধু নয় সকলকেই এটা জিজ্ঞাসা করে। একদিন তারও দোকানে খদ্দের নেই, আমারও সময় কাটানোর কেউ নেই। তার সাথেই আড্ডা দেব ভাবলাম। বেশ দাড়ি রাখে। পাঁচবার নামাজও পড়ে। কথায় কথায় বললাম, কোরাণে কত বাজে কথা লেখা আছে জানো? লেখা আছে অমুসলিমের সাথে বন্ধুত্ব করা, ওঠা বসা নিষিদ্ধ। সে তো এর তীব্র প্রতিবাদ করলো।
“কিছুতেই এটা থাকতে পারে না। কোরাণে নানান সুরা আছে, আয়াত আছে। এসব কেন লেখা থাকবে?”
আমিও ছেড়ে দেবার পাত্র নই, মোবাইলে কোরাণ খুলে দেখাই। সে বলে, মোবাইলের কোরাণ মানি না। ওটা কোরাণ নয়। বললাম, তাহলে বাড়ি গিয়ে তোমার কোরাণ খুলে দেখে নিও, না পেলে আমাকে ডেকো।
সে কী বললো জানেন?
-আমি তো লেখা পড়া জানি না। তবে আমার মনে হয় কোরাণে এসব বাজে কথা লেখা থাকতে পারে না।
অতঃপর তাকে ধরলাম অন্য বিষয়ে।
-এই যে বলে বুরাখ চেপে নবীজি সাত আকাশ উড়ে মেরাজ করেছিল, এটা মানো?
সে বলে, ‘অবশ্যই মানি’।
- তাহলে বলো কিভাবে বুরাক আকাশে উড়তে পারে? সেটি তো গাধা আর খচ্চরের মাঝামাঝি ডানাওলা এক প্রাণী। সে কখনও মহাকাশে যেতে পারে?
সে বলে, ‘এই মেরাজটা তো বাস্তবিক সম্ভব নয়। আসলে এটার ভিতরে বিশাল অর্থ আছে। পুরো ব্যাপারটাই কল্পনা, আধ্যাত্মিক। বাস্তবিক নয়। ’
এরা ধর্ম বিশ্বাসী। তবু তাদের কথা বলছি কেন? কারণ তারা ধর্মগ্রন্থকেও পুরো বিশ্বাস করে না। অবাস্তব গুলোকে আধ্যাত্মিক বলে সন্তুষ্ট হতে চায়, কারণ তারাও বোঝে বাস্তবে তা হওয়া অসম্ভব। বাস্তববোধ তাদের আছে। তাই তাদের মাঝে কিছুটাও প্রশ্ন করার মানসিকতা জাগে। তাদের মাঝেও যুক্তিবাদের স্ফুরণ সম্ভব। মানুষ স্বভাবতই যুক্তিশীল। যুক্তিযুক্ত বিষয় তার মনে ধরে। বাস্তবজীবনে তার প্রয়োগও করে। তাই অতিবড় অযৌক্তিক বিষয়কেও কুযুক্তি দিয়ে যুক্তির ছদ্মবেশে বিজ্ঞানের মোড়কে খাওয়ানোর প্রয়োজন হয় অলৌকিকতা নির্ভর ব্যবসাকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে।
Thanks