- অরণ্য দাস
-- ওঠ বাবাই,না হলে স্কুলের দেরি হয়ে যাবে।
-- আর একটুখানি মা।
-- না, আর এক ফোঁটাও না। এখন না উঠলে স্কুলের বাস পাবি না। আর তারপর স্কুলে স্যারদের বকুনি খাবি।
মায়ের কথাগুলি শুনে বাবাই শেষমেষ ঘুম থেকে না উঠে আর থাকতে পারলো না।সে এইবার তাড়াতাড়ি স্কুলে যাবার জন্য তৈরি হতে লাগল।
খানিক পরে সে পোশাক পরে মা কে বলল--
-- মা ব্রেকফাস্টে কী আছে ?
-- তোর ফেভারিট ফুলকো লুচি আর ঘুগনি।নে এইবার চটপট এগুলো খেয়ে নে।
বাবাই তার প্রিয় খাবার গুলো পেয়ে গোগ্ৰাসে তা খেতে লাগলো।খাওয়া শেষ হওয়ার পরই ঘরের সামনে শোনা গেল স্কুল বাসের হর্ন। বাবাই ব্যস্ত হয়ে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বাসে চাপলো।তার মা চেয়ে দেখলো বাসটা ধোঁয়া উড়িয়ে বহুদূর চলে গিয়ে ক্রমে ক্ষীণ হয়ে আসছে।
এই ব্যস্ত শহরে অরূপ ও রূপসার ছোট্ট একটি সংসার। বাবাই তাদের একমাত্র ছেলে।ভালো নাম অনির্বাণ।অরূপের স্বপ্ন, সে তার ছেলেকে অনেক বড়ো করবে, মানুষের মতো মানুষ করবে।তাই সে একটা ছোট অফিসে কেরাণী হয়েও তার ছেলেকে নামী ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করেছে। বাবাই এর যাতে কোনো কিছুর অভাব না হয় সেই দিকে তার সর্বদা সচেষ্ট দৃষ্টি। নিজের কোনো বিলাসব্যসন, বিনোদনের দিকে তার নজর নেই।তার সর্বদাই চিন্তা এই মূল্যবৃদ্ধির বাজারে কীভাবে তার পাওয়া স্বল্প বেতন থেকে তার ছেলের সমস্ত চাহিদা সে পূরন করবে।
বাবাই কোনদিন অভাবের একবিন্দুরও উপস্থিতি টের পায়নি।সে জানতেই পারে না তার মা বাবার কতটা স্বার্থত্যাগের ফসল হল ওই ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ও তার প্রয়োজনীয় সামগ্ৰী।
এইভাবে দিন কাটতে থাকে। অরূপ ও রূপসার চোখের স্বপ্ন দিন দিন বৃহৎ থেকে বৃহত্তম হতে থাকে।এই অতিবৃহৎ স্বপ্নের কাছে তাদের দৈনন্দিন সংগ্ৰামী জীবনের দুঃখ কষ্ট নেহাতই ক্ষুদ্র মনে হয়।
এরপর সময়গঙ্গা দিয়ে বয়ে যায় বহু স্রোত।কত পাড় যে ভাঙল আর কত যে গড়ল তার কোন হিসেব নেই।
বাবাই আজ বড়ো হয়েছে। ছোট্ট চারাগাছ আজ মহিরূহে পরিনত হয়ে ডালপালা মেলেছে।সেই ডালে পাখির মত ঝাঁকে ঝাঁকে বাসা বেঁধেছে স্বপ্ন।
ছোট বেলা থেকে বাবাই বরাবরই মেধাবী ছাত্র হিসাবে পরিগণিত হয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে তার ভালো ফলাফল তার মা বাবার দেখা স্বপ্নকে আরও সুদৃঢ় করে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে M.A. পাস করার পর সে তার বাবাকে বলল - বাবা আমি উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ যেতে চাই,তার জন্য পাঁচ লাখ টাকা দরকার।
অরূপ তার ব্যাঙ্কের পাঁচ লাখ টাকার সমস্তটাই তুলে দিল ছেলের হাতে। একবারও তার মনে হয়নি তার শেষ সম্বল এই পাঁচ লাখ টাকা খরচ হয়ে গেলে সে ও তার স্ত্রী কীভাবে দিন কাটাবে।কারন সে জানতো তার ছেলে একদিন ঠিক মানুষের মত মানুষ হবেই।
এরপর বাবাই তিন বছরের জন্য বিদেশে চলে গেল।তার মা বাবা তার ফিরে আসার প্রতীক্ষায় বুক বেঁধে বসে রইল।
দেখতে দেখতে তিনটে বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেল।এখন অরূপ আর রূপসার বয়স বেড়েছে। অরূপও এক বছর হল অফিস থেকে রিটায়ার্ড হয়েছে। বিদেশ থেকে MBA করে ফিরে বাবাই অর্থাৎ অনির্বাণ বোস এখন কোলকাতার এক নামজাদা কোম্পানির CEO. অরূপ আর রূপসার দেখা বহু প্রতীক্ষিত স্বপ্ন আজ সত্যি। তাদের ছেলেকে মানুষের মত মানুষ করতে চাওয়া প্রচেষ্টা আজ পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। অমাবস্যার পরে প্রতিপদের চাঁদের ফিকে আলো যেমন গুমোট অন্ধকারের হাত থেকে পৃথিবীকে টেনে তোলে সেই রকমই দারিদ্র্যের হাত ছাড়িয়ে অরূপ আর রূপসার পৃথিবীতে দেখা গেল সুখের দীপ্তি।
এক বছর পর অনির্বাণ বিয়ে করল। দু'বছর সুখে বৈবাহিক জীবন অতিবাহিত করার পর তার এখন একটি পুত্রসন্তান হয়েছে। অনির্বাণের স্ত্রীও চাকরি করে। তাদের ছেলে তার ঠাকুরদা ও ঠাকুরমার স্নেহেই পালিত হতে লাগল।
অরূপ আর রূপসার বয়স এখন যথাক্রমে আশি ও পঁচাত্তর। ছেলের জন্য তাদের গর্বে সবসময় বুক ফুলে থাকে। সেই সব আত্মীয়-স্বজন আজ তাদের দুজনকে যথেষ্ট সম্ভ্রমের চোখে দেখে যারা এক সময় মুখ বেঁকিয়ে বলেছিল - ছেলেকে এত পড়িয়ে কি হবে? ডাক্তার না ব্যারিস্টার?
একদিন অনির্বাণ বাবাকে বললো-- বাবা একটা কথা ছিল।
-- হ্যাঁ, বল।
-- বলছিলাম যে তুমি আর মা যদি অন্য কোথাও গিয়ে থাকো তাতে কি তোমাদের কোন আপত্তি আছে?
-- কেন বাবাই? হঠাৎ তুই এইরকম কথা বলছিস? আমাদের জন্য কি তোদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে?
-- তা ঠিক নয়। আসলে তোমরা হলে একটু পুরোনো দিনের, ওই যাকে বলে ব্যাক ডেটেড। এই সমাজে আমার অনেক নামডাক আছে। গত পরশু বাড়িতে যে পার্টিটা হয়েছিল সেখানে তোমাদের বড্ড বেমানান লাগছিল। আমার তো সবার কাছে তোমাদের পরিচয় দিতেই লজ্জা লাগছিল। তাছাড়া আমার ছেলে বড় হচ্ছে, তার জন্য ওই পশ্চিমের ঘরটা, যেখানে তোমরা থাকো সেইটা চাই। তাই বলছিলাম তোমরা যদি এখন একটু বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে থাকো।
-- কি বললি! আমাদের পরিচয় দিতে তোর লজ্জা করে? তোদের সঙ্গে আমরা বেমানান! হায় ভগবান! আমি কি তোকে এইরকম মানুষ করতে চেয়েছিলাম? কথাগুলি বলতে বলতে বৃদ্ধ অরূপের চোখ থেকে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে।
দুপুরে খাবার পর অরূপ তার স্ত্রীকে ডেকে সমস্ত কথা বলল। সেই শুনে তার স্ত্রী হতভম্ব হয়ে গেল। খানিক পরে তারা দুজনে ঠিক করলো, ছেলেই যদি না চায় তারা বাড়িতে থাকুক তখন তারা আর এই বাড়িতে থাকবে না।
পরের দিন বুকে পাথর রেখে তারা বাড়ি ছাড়ার জন্য প্রস্তুত হল। তাদের নাতি অংশু খুব কাঁদছিল আর বলছিল - দাদু , ঠাম্মা তোমারা যেয়ো না। কিন্তু যেই বিহঙ্গকে পিঞ্জর থেকে দূর করে দেওয়া হয় সে কি আর পিঞ্জর পানে চায়! যাওয়ার সময় তাদের বারবার মনে পড়তে লাগলো বাবাইয়ের ছোট্টবেলার কথা।বাবাই এর জন্য তারা কিনা করেছে।বাবাই কে বড়ো মানুষ করবে বলে তারা তো তাদের সমস্ত সুখ জলাঞ্জলি দিয়েছিল। কিন্তু সেই বাবাই কিনা আজ তাদেরকে তাড়িয়ে দিচ্ছে। হায়রে উচ্চ শিক্ষিত মানুষ! এই কি তবে মনুষ্যত্ব! নারির টানই যখন ছিন্ন হয়ে যায় তখন কি আর আসে যায় দৈহিক দুঃখ কষ্টে।
অরূপ আর রূপসার ঠিকানা এখন বৃদ্ধাশ্রম।এই বৃদ্ধাশ্রমই শত শত বাবাইয়ের মা বাবার অন্তিম ঠিকানা, শেষ আশ্রয়স্থল। তাদের চোখেও কোনদিন ছিল ছেলেকে বড়ো করার স্বপ্ন, কিন্তু তারা ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারেনি ছেলে বড়ো হলে তাদেরকে ছেলের কাছে ছোট হতে হবে, হতে হবে সংসারের বোঝা, তাদের থেকেও বাড়ির পোষ্য কুকুরটার আদর আপ্যায়ন হবে বেশি। মাঝে মাঝে অতীতের স্মৃতি তাদের চোখে নামিয়ে দেয় অকাল বর্ষা। যার জলে ধুয়ে যায় দুঃখ কষ্টের আবর্জনা। শুধু থেকে যায় তার ছাপটুকু। এইভাবেই বৃদ্ধাশ্রমে দিন কাটাতে কাটাতে একদিন অরূপ ও রূপসা ইহজগতের সঙ্গে সমস্ত যোগসূত্র ছিন্ন করে দুঃখ কষ্ট থেকে মুক্তি পেল।
এরপর পৃথিবীর অমোঘ নিয়মেই কেটে যায় বহু বছর।বাবাই মানে মিঃ অনির্বাণ বোস এখন ৭০ বছরের বৃদ্ধ। তার ছেলে অংশুমান এখন বিলেত ফেরত ইঞ্জিনিয়ার।সে কলকাতার PWD ডিপার্টমেন্টের হেড ইঞ্জিনিয়ার। সেও বিয়ে করেছে এবং বর্তমানে একটি পুত্র ও কন্যা সন্তানের অধিকারী।
হঠাৎ একদিন অংশুমান তার বাবাকে ডেকে বলল - বাবা কিছু কথা ছিল।
-- দেখ বাবা তোমার বৌমা বলছে ,ও আর তোমাদের দেখভাল করতে পারবে না। তোমরা অন্য কোথাও গিয়ে থাকো।তাছাড়া আমাদের স্টেটাস এখন খুব হাই।তোমরা আমাদের সঙ্গে মানাতে পারবে না।আর তোমাদের জন্য সমাজে , বন্ধুদের কাছে আমার নাক কাটা যাবে।তোমরা বরং বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে থাকো।আমি না হয় মাসে মাসে কিছু টাকা পাঠিয়ে দেব।
কথাগুলো শুনে বৃদ্ধ অনির্বাণ ধপ করে সোফায় বসে পড়ল। তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসতে থাকে। তার কানে বাজে ছেলের বলা কথাগুলো। তার কন্ঠনালী রুদ্ধ হয়ে আসে। হঠাৎ তিনি ফিরে যান ৪০ বছর আগে। তার মনে পড়ে যায় ঠিক এইরকমই কথাই তিনি বলেছিলেন তার মা বাবাকে।তখন তিনি বুঝতে পারেননি ঠিক কি রকম বিধ্বংসী ঝড় বয়ে গিয়েছিল তার বাবা মার মনের উপর দিয়ে।আজ তিনি তার উপলব্ধি করতে পারছেন।৪০ বছর আগে তারই বলা কথাগুলো আজ বুমেরাং এর মত ফিরে এসে শেলের মত বিঁধেছে তার বুকে।তার চোখের কোন থেকে নেমে আসে অশ্রুধারা।এই অশ্রুধারা তার মা বাবাকে ৪০ বছর আগে বাড়ি থেকে বের করে দেবার অনুতাপের।এই জগতে কর্মফল বলে এক বিষম বস্তু আছে যার হাত থেকে কারো নিস্তার নেই।সকল পুত্রই ভুলে যায় সেও একদিন পিতা হবে, হয়তো তার পুত্রও তার সঙ্গে এই রকম দুর্ব্যবহার করবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তথাকথিত বড়ো মানুষের মুখোশ ও বিলাসী সমাজের মায়া চাদরে ঢাকা তাদের চোখ জগতের এই নির্মম বাস্তবের মাঝে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।
Comments