-শ্রেয়সী মল্লিক
উত্তাপই যে প্রাণের রক্ষক এই আদত কথাটার সশব্দ বিজ্ঞাপনের জন্যই বোধহয় রাখিবন্ধন দিবসের মধ্যাহ্নে অগ্নিপ্লাবী হয়েছে দিনমণি। কিন্তু ধূমপিপাসু জীব হবার সুবাদে ঠান্ডা হল ছেড়ে রোদে তেঁতে ওঠা করিডরে একবার আসতেই হল অনিকেতকে।একটু আগেই শেষ হয়েছে তার বই প্রকাশ অনুষ্ঠান।এই উপন্যাসটার পটভূমি ডুয়ার্স। তাই সেমিনারের সঙ্গে সঙ্গে উপন্যাস প্রকাশেরও বন্দোবস্ত করেছিলেন তার এই পুরনো কলেজের বিভাগীয় প্রধান। আপত্তি করেনি অনিকেত। সত্যি কথা বলতে উত্তরবঙ্গের এই মফঃস্বলী কলেজটায় জীবনের প্রথম চাকরি না হলে অনিকেতের কলকাতা কাতর কলমে এমন পাহাড়ি নিস্বন শোনা যেত না। চার বছর ডুয়ার্স যাপনই অনিকেতের শিল্প-পাকশালায় স্বাদ বদল ঘটিয়েছে,প্রথম আঞ্চলিক উপন্যাস লিখেছে সে। তাই এখানে বই প্রকাশ অনিকেতের কাছে খানিকটা ঋণশোধও বটে।
মাঠের প্রান্ত থেকে রাখি উঁচিয়ে এগিয়ে আসছে মেয়েটা, লক্ষ্য গোলপোস্টে হেলান দিয়ে দাঁড়ান সহপাঠী, যে কিনা প্রাণপন চেষ্টায় সপ্রতিভতা বজায় রাখতে চাইলেও মুখের আলোগুলো নিবে যাচ্ছে একটা একটা করে। অজান্তেই তার অভিব্যক্তির ময়নাতদন্ত চলছে লেখকের চোখে। ছেলেমেয়ে দুটো যেন ওদের বয়স ফিরিয়ে দিচ্ছে অনিকেতকে। দীর্ঘ সুখটানের সঙ্গে সঙ্গে সদ্য তারুণ্যের তোরণে পা রাখার সুখসময়টাকেও প্রশ্বাসে আগলে নিল ও।
মাস্টার বাবু চিনতে পারতছ?
চমকে উঠল অনিকেত।
প্রখর সূর্যকে আড়াল করে দাঁড়িয়েছে যে তরুনী তাকে দেখলে মনে হয় অপটু শিশ্পীর হাতে তৈরি ডাকিনীর টেরাকোটা মূর্তি। মুখটা বেঢপ বাঁকা চোরা,নাক চ্যাপ্টা।এ মেয়ের বাকশক্তি শুধু মুখেই আটকে নেই,চোখ ও সে অধিকারের ঝান্ডা গেড়েছে। কপালের রেখাগুলি চলতে চলতে হঠাৎ পথ হারিয়ে ফেলেছে ক্ষুব্ধ কোনো বিক্ষোভে। ...ভামর!
ইস,কি রোগা হয়ে গেছ গো ! শুনলাম আজকে তোমার বই বার হবে,তাই আসলাম।খালি হাতে আসি নাই,এমন পুন্ন দিন।কই হাতটা দাও। চারপাশের বাতাস কি কমে এল হঠাৎ! অনিকেতের শিরায় শিরায় যেন উইপোকা লেগেছে।কটছে কুরকুর। ষড়ঋতুর হিসাব গুলিয়ে গেল নাকি পৃথিবীর প্রৌঢ় মস্তিষ্কে,নইলে এত শীত করছে কেন?
পরিশীলনের প্রলেপ মাখা,সারস্বত চর্চার প্রতিশ্রুতি ভরা অনিকেত বসুর নরম হাতটা কোন এক চুম্বকের টানে ভামর প্রামাণিকের খড়ি ওঠা খসখসে আঙুলের ফাঁকে আটকে থাকা রাখির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।তিন বছর আগে ঠিক এভাবেই ভামরের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল এই কলেজের অধুনা প্রাক্তন অধ্যাপক।প্রথম চাকরির স্বাধীনতা, পরিবার ও বাগদত্তার কাছ থেকে দূরে নির্জন পরিবেশ কেমন যেন মত্ত করে ফেলেছিল অনিকেতকে। তাই কলেজের বাইরে চা রুটির দোকানের মালিকের মেয়ে ভামরের মধ্যে উত্তেজক উপাদানের নিতান্ত অভাব সত্ত্বেও সেই তখন অনিকেতের তন্বী শ্যামা শিখরদশনা। তোকে নিয়ে কবিতা লিখব ....তুই আমার অভিমানী তিস্তা নদী...ভালোবাসি ভালোবাসি ভালোবাসি _এরথেকে বেশি পরিশ্রম করতে হয় নি ষোল বছরের ভামরকে ভোলাতে।
আমাকে কলকাতা নিয়ে যাবা ত মাস্টার বাবু, তোমার বাড়ি কাজ করব, তুমি শুধু আমাকে কবিতা শুনাবা ...... কলকাতার কলেজে অনিকেতের ট্রান্সফারের কথা শুনে কান্নার দমক ঠেলে এটুকুই বলতে পেরেছিল ভামর। মাস্টার বাবুর মধ্যে জেগে ওঠা উদ্দাম আদিম পুরুষ তখন কলকাতার শীততাপ নিয়ন্ত্রিত জীবনের দরজার বাইরে আত্মহত্যা করেছে।ভামরের চোখে আর নিজের সর্বনাশ দেখতে পায় নি অনিকেত,তার দেহে মনে ঘরে ফেরার গান, চৈত্রের বস্তাপচা শেষ প্রহর তখন রাঙা আলো হারিয়ে ধূসর।কদিন পর এসে তোকে নিয়ে যাব ভামর, তোকে ছেড়ে থাকতেই পারব না এটুকু অভিনয় করতে হয় বলেই না মনীষীরা বলে গেছেন জীবন আসলে রঙ্গমঞ্চ।
এরপরও অবশ্য ভামরের খোঁজ রেখেছিল অনিকেত। এখানকার বন্ধুদের থেকে জেনেছিল বাবা মারা যাবার পর ওদের দোকানটা উঠে গেছে। এবারের উপন্যাসটা লেখার সময় ডুয়ার্সের বন পাহাড়ের মাঝখান থেকে ভামরকে মুছে ফেলতে খুব দামী ইরেজার লাগেনি লেখকের।
তুমি... মানে তুই আমাকে রাখি পরাবি!
হ্যাঁ গো, ছোটবেলা থেকে শুইনে আসতেছি রাখি পরাইলে নাকি রক্ষা করে। তুমি আমারে যা বাঁচান বাচাইলা, রাখি ত পরাইতেই হবে।
অসংখ্য লূতাতন্তুর মাঝে ফেঁসে গেছে অনিকেতের স্বরযন্ত্রটা। শুকনো পাতার মতো খরখরে গলায় বলল,কি যা তা বলছিস, আমি আবার তোকে কবে বাঁচালাম?
দোকানটা উইঠে যাবার পর রান্নার কাজ নিলাম এক বাড়ি। সেখানে আমারে দেখলে দাদার নাল গড়ায়।বলে আমারে পাইলে নাকি বৌদি রে ছাইড়ে দিবে। অনেক দিন থেকেই অসভ্যতামি করতেছিল, কিছু বলি নাই গো,কি জানি আমারও বুঝি নেশা ধইরে গেছিল।
সেদিন ফাঁকা বাড়ি পায়ে আমারে বিছানায় বসায়ে দাদা যখন আদুল গা হল... বুকের কালো লোম আর কেন্নোর মত হাতের শিরা গুলি দেইখে তোমার চেহারাটা ভাইসে উঠল চোখের উপর।ফর্সা জামাকাপড়গুলা খুললে দুজনেই এক। অমনি দিলাম যম কামড়। হাতের একেবারে মাংস উঠায় নিছি গো। শেষ গিঁটটা বাঁধতে বাঁধতে দাঁতে দাঁত চেপে বলল ভামর।
তারপর একটা সস্তা দামের ক্যাটক্যাটে রঙ রাখির ফাঁস ছড়িয়ে পড়ল মোহময়ী ডুয়ার্সের কোণ থেকে কোণে। তিস্তার প্রতিটা বুদ্বুদে। অনেক হাততালির মধ্যে সদ্য ফিতে কাটা উপন্যাসটা র খুদে কালো অক্ষরে অক্ষরে। প্রতিটা সুখী অস্তিত্বের সুখ ছিঁড়ে দিয়েই শেষ হয় ভামর প্রামাণিকদের রাখিবন্ধন উৎসব।
এই বাঁধনে আগুনের গন্ধ। রক্ষক দীর্ঘজীবী হোক।
Comments