-অরণ্য দাস
--- হ্যালো অরুণ.......
--- হ্যাঁ বল ....
--- ভাই খুব বড়ো একটা বিপদ হয়ে গেছে।
--- কেনো কি হলো রে? তুই অতো হাঁপাচ্ছিস কেন?
--- বাবা..... বাবার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। হসপিটাল থেকে ফোন এসেছিল। আমি এখন হসপিটালে আছি। বাবার প্রচুর রক্ত বেরিয়ে গেছে। ডাক্তার বললো বাবাকে বাঁচাতে হলে প্রায় পাঁচ-ছয় বোতল রক্ত লাগবে। তুই একটু দেখ না যদি তোর চেনা জানা কারো O নেগেটিভ রক্ত থাকে। আমি ব্লাড ব্যাঙ্কে গিয়েছিলাম, সেখানে মাত্র দু বোতল রক্ত পেলাম। আর রক্ত না পেলে বাবাকে বাঁচাতে পারবো না। একনিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে সৌমেন কেঁদে ফেললো।
--- কাঁদিস না সৌমেন, আমি দেখছি কি করা যায়। তুই চিন্তা করিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে।
ফোনে কথা বলা হয়ে যাবার পর সৌমেন উদ্বিগ্ন মুখে বাবার ওয়ার্ডে প্রবেশ করল।
--- ডাক্তারবাবু বাবা কেমন আছে?
--- আমাদের যতটা করার করছি। পেশেন্টের শরীর থেকে প্রচুর রক্ত বেরিয়ে গেছে। হার্ট খুবই দুর্বল।
--- ডাক্তারবাবু বাবা বাঁচবে তো?
--- দেখুন পেশেন্ট-এর কন্ডিশন খুবই সিরিয়াস। এখন কিছুই বলা যাচ্ছে না। যদি রক্তটা জোগাড় করতে পারেন তাহলে একটা ক্ষীণ আশা আছে। এখন আপনি বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করুন।
সৌমেন নিঃশব্দে বাইরে এসে একটা চেয়ারে বসে পড়ল। ভাবতে লাগল কি করবে সে এবার।
আজ সকাল অবধিও সব কিছু ঠিকই ছিল। সৌমেন তার বাবার সঙ্গে প্রাতঃরাশ করতে করতে দেশের রাজনীতি নিয়ে কথা বলছিল। বাড়িটাতে সৌমেন ও তার বাবা শ্যামলাল মিত্র মাত্র এই দুই প্রানীর বাস। সৌমেনের মা গত হয়েছেন বহুদিন। সৌমেন একটা সওদাগরী অফিসে কাজ করে। তার বাবার বয়স হয়েছে, প্রৌঢ়ত্বের গন্ডী পেরিয়ে তিনি এখন বার্ধক্যে উত্তীর্ণ হয়েছেন। এই বয়সেও তিনি এখনও একদম সুস্থ সবল আছেন। রোজ সকালে নিয়মিত প্রাতঃভ্রমন করেন। নিজের হাতে বাজার করেন। যৌবনে যে তিনি খুব কঠোর নিয়ম ও অনুশাসন মানতেন তা এখন দেখলেই বোঝা যায়।
যদিও এর বাইরে তার আরও একটি পরিচয় আছে। তিনি ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্ৰামী। ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সেই সময় যে সব অনামী তরুণ বালক, যুবকেরা দেশের স্বার্থে প্রানপণ করেছিল তাদের মধ্যে তিনিও একজন। যখন থেকে তিনি বুঝতে পারেন ভারত পরাধীনতার শৃঙ্খলে বদ্ধ, লাঞ্ছিত, নিপীড়িত ব্রিটিশ শাসনের কাছে তখন থেকেই তিনি দেশের মুক্তির জন্য নিবেদিত প্রাণ। তিনি যোগ দেন একটি বিপ্লবী সংগঠনে। সেখানে নিয়মিত শরীরচর্চা,অস্ত্রশিক্ষার পাশাপাশি ব্রিটিশ বিরোধী বহু পুস্তক ও পত্র-পত্রিকার পাঠ চলতো। "পথের দাবী"র মতো পুস্তক পাঠ তার স্বাধীনতা চেতনাকে আরো বহুগুন বাড়িয়ে তুলেছিল। সমস্ত রকম ব্রিটিশ বিরোধী কার্যকলাপের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। বহুবার তাকে ধরার চেষ্টা করা হয়েছিল পুলিশের পক্ষ থেকে কিন্তু প্রতিবারই তিনি পালাতে সক্ষম হতেন। শেষে একবার গোপন সূত্রে খবর পেয়ে গভীর রাতে এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে ব্রিটিশ পুলিশ তাকে গ্ৰেফতার করে। লকআপে তার উপর চলে অকথ্য অত্যাচার। অমানবিকভাবে তাকে পেটানো হয়,তার হাত পায়ের নখ উপড়ে নেওয়া হয়। তবুও পুলিশ তার কাছ থেকে বিপ্লবীদের কোন তথ্যই বার করতে পারেনি। তাকে রাজসাক্ষী হওয়ার জন্যও লোভ দেখানো হয় কিন্তু তার অদম্য জেদ ও মনোবলের সামনে ব্রিটিশ পুলিশও হার মেনে যায়। শেষে তাকে আদালতে পেশ করা হয়। ব্রিটিশ আইনের চোখে দেশদ্রোহী কার্যকলাপের জন্য তাকে যাবজ্জীবন কারাবাসের হুকুম দেওয়া হয়। অবশেষে তার ঠাঁই হয় জেলে। কিন্তু ওদিকে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। ভারতীয়দের অসহযোগিতা ও বিদ্রোহের আঁচ তখন সুদূর ব্রিটেনের গায়েও লেগেছে। ব্রিটিশ সরকার ভালো করেই বুঝে গিয়েছে আর তারা বেশিদিন ভারতকে শাসন করতে পারবে না। তাদের এতদিনের উপনিবেশ এবার ত্যাগ করতে হবে।
তারপর এল সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত। সেই বহু কাঙ্ক্ষিত দিন। ১৯৪৭ সালের ১৫ই অগাষ্ট লর্ড মাউন্টব্যাটেনের কাছ থেকে ভারতের শাসন ক্ষমতা চলে এল ভারতীয়দের হাতে। যদিও এর জন্য ভারতকে মূল্য চোকাতে হল। ভারত বিভক্ত হয়ে জন্ম হল মুসলমান রাষ্ট্র পাকিস্তানের। ভারত ছেড়ে যাবার আগে ভারতের ঐক্যকে চিরদিনের জন্য দুর্বল করে দেবার জন্য ব্রিটিশ শাসকের কূটনৈতিক অঙ্গুলিহেলনে হিন্দু-মুসলমান এর মধ্যে লেগে গেল সংঘর্ষ। সেই দাঙ্গায় অসংখ্য হিন্দু মুসলমান হত হল। বহু মুসলমান পাকিস্তানে চলে গেল। বহু হিন্দু পাকিস্তান থেকে ভারতে চলে এল। ইংরেজ এ দেশ ছেড়ে চলে যাবার আগে শেষ বারের মত ভারতের বুকে দিয়ে গেল পাকিস্তান নামক সুগভীর ক্ষত। প্রায় ২০০ বছরের ব্রিটিশ শৃঙ্খল ত্যাগ করে স্বাধীন হল ভারত। এই দিনটির জন্যই ক্ষুদিরাম,ভগৎ সিং সহ বহু ভারতীয় হাসি মুখে মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছিল। এরপর ধীরে ধীরে জেল থেকে বহু স্বাধীনতা সংগ্ৰামীকে মুক্ত করে দিল ভারত সরকার। শ্যামলাল বাবুও ছাড়া পেলেন জেল থেকে। ইতিহাস বইয়ের পাতায় যেমন সমস্ত স্বাধীনতা সংগ্ৰামীর কথা উল্লেখ থাকে না সেইরকম শ্যামলাল বাবুরও উল্লেখ নেই। তবুও তার এলাকার সকলেই এই সব কথা জানে ও তাকে যথেষ্ট সম্মান করে।
প্রাতঃরাশ পর্ব শেষ হবার পর শ্যামলালবাবু ব্যাগ নিয়ে বের হন বাজারের উদ্দেশ্যে। যদিও সৌমেন বলেছিল, তোমাকে যেতে হবে না বাবা, আমি কয়েকটা কাজ সেরেই বাজারে যাব। সে কথায় আমল না দিয়ে শ্যামলালবাবু বলেন, তোকে যেতে হবে না, তুই বরং তোর অফিসের কাজগুলো শেষ কর। আমি তো সারাদিন বাড়িতে একাই থাকি, বাইরে বেরিয়ে বাজারে গেলে আমারও একটু ভালো লাগবে। এই বলে তিনি ব্যাগ নিয়ে দরজা দিয়ে বেড়িয়ে গেলেন।
রাস্তায় যেতে যেতে তিনি ভাবতে লাগলেন তার স্বাধীনতা সংগ্রামের সমস্ত কথা। সেই সময়ে তারা কত নিষ্ঠা নিয়ম মেনে সৎ পথে চলতেন, কিন্তু বর্তমান যুবসমাজের যেন কোনো দিশা নেই। তারা যেন হালবিহীন নৌকার মত মহাসমুদ্রে ভাসছে। ঢেউয়ের স্রোতের মত বর্তমান সমাজের অনৈতিক দোলাচলে তারা অভিমুখহীনভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। এই যুবসমাজের দরকার নেতাজী সুভাষ বা বিবেকানন্দর মতো একজন পথপ্রদর্শকের। এই সমস্ত কথা ভাবতে ভাবতে তিনি প্রায় বাজারের সামনে চলে এসেছিলেন। হঠাৎ একটা দ্রুতগামী লরি একটা ট্রেকারকে পাশ কাটাতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সজোরে ধাক্কা মারে শ্যামলালবাবুকে। দূরে ছিটকে পড়েন তিনি। তার মাথা ফেটে যায়, সারা শরীর থেকে গলগল করে বেরোতে থাকে প্রচুর রক্ত। সেই রক্তে রাঙা হয়ে যায় রাস্তা। ততক্ষণে আশেপাশের কিছু লোক জড়ো হয়ে যায়। বেগতিক দেখে লরিড্রাইভার খুব দ্রুত গতিতে লরি ছুটিয়ে চম্পট দেয়। জনতার মধ্য থেকেই একজন অ্যাম্বুলেন্সে ফোন করে। মিনিট কুড়ির মধ্যে অ্যাম্বুলেন্স চলে আসে। ততক্ষণে শ্যামলালবাবুর শরীর থেকে প্রচুর রক্ত বের হয়ে গেছে। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় হসপিটালে। তার বুকপকেটের ডাইরি থেকে সৌমেনের ফোন নম্বর পায় পুলিশ। হসপিটাল থেকে বাবার খবর শুনে তড়িঘড়ি সেখানে উপস্থিত হয় সৌমেন। ডাক্তারের কাছ থেকে সে জানতে পারে বাবাকে বাঁচাতে প্রচুর রক্ত লাগবে। ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে মাত্র দুই বোতল রক্ত পেয়েছে সে। এখনো তিন-চার বোতল রক্ত লাগবে। বন্ধু অরুণকে সে ফোন করেছে, দেখা যাক কোন রকম অন্য ব্যাবস্থা হয় কিনা।
হাসপাতালের চেয়ারে বসে বসে এই সব চিন্তা করতে করতে একটু আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল সৌমেন। হঠাৎ ফোন বাজার শব্দে তার চটকা ভেঙে গেল। মোবাইলটা বার করে দেখল অরুণ ফোন করছে। ফোনটা রিসিভ করে সৌমেন বললো - হ্যালো অরুণ, কিছু ব্যাবস্থা হলো? ডাক্তারবাবু বলছে রক্ত না পেলে আর কোন আশাই থাকবে না।
--- না রে সৌমেন কিছু করতে পারলাম না.....
--- তোর চেনা জানা কারও O নেগেটিভ রক্ত নেই? একজনেরও নেই? ব্লাড ব্যাঙ্কে তো দুটোর বেশি রক্তের বোতল পেলাম না। তুইই আমার শেষ ভরসা ছিলিস।
--- আসলে তা নয়। চেনাশোনা দু-তিন জনের O নেগেটিভ রক্ত আছে। তাদেরকে ফোন করে বলেছিলাম কিন্তু তারা কেউই রক্ত দিতে রাজি নয়।
--- কেন রাজী নয়? রক্ত দেওয়া তো কোন খারাপ কাজ নয়। তাঁরা রক্ত দিলে যদি একজন মানুষের জীবন বাঁচে,তাও তাঁরা রক্ত দেবে না?
--- জানি না কেন তাঁরা রক্ত দিল না, তাদের অনেক করেই বললাম কিন্তু তারা সোজাসুজি বলে দিল তারা রক্ত দেওয়ার মধ্যে নেই। আমি কাকুর অবস্থার কথাও বললাম কিন্তু তাদের মত পরিবর্তন হল না। আমার যদি O নেগেটিভ রক্ত হতো আমি নিজেই দিতাম কিন্তু আমার B পজেটিভ রক্ত। হ্যালো, সৌমেন কথা বলছিস না কেন? কিরে? আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস? হ্যালো....
খুট করে ফোন কাটার শব্দ হল। ফোনটা নামিয়ে পাথরের মত চেয়ারে বসে রইল সৌমেন। নাহ্,বাবাকে বাঁচানোর শেষ আশাটুকুও শেষ হয়ে গেল। সে দুঃখে বিস্ময়ে ভাবতে লাগলো তাদের কথা যাদের রক্ত O নেগেটিভ হওয়া সত্ত্বেও রক্ত দিতে রাজি হলো না। এতটাই অমানবিক তারা। একটা মানুষের জীবনের চেয়ে তাদের কাছে কিছুটা রক্ত বেশি দামী হয়ে গেল। হায় ঈশ্বর! যে মানুষটা দেশের স্বাধীনতার জন্য রক্ত ঝরাতে কোন কার্পণ্য করে নি, সেই কিনা আজ রক্ত না পেয়ে মারা যাচ্ছে। যাদের রক্তের ফোঁটায় ধরিত্রী সিক্ত হয়েছিল এক সময়ে তাদের এই করুন অবস্থা। দেশের স্বার্থে দশের স্বার্থে যারা নিজেদের উৎসর্গ করে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিয়ে এসেছিল, তাদের জীবন বাঁচানোর স্বার্থে এখন কেউ এগিয়ে এলো না। এই অমানবিক হৃদ্যতাহীন ভারতবর্ষের জন্যই কি তাঁরা জীবন বাজী রেখে সংগ্ৰামের পথে হেঁটেছিল?
এই সমস্ত প্রশ্ন রেখে গেল শ্যামলাল মিত্রের প্রায় রক্তশূন্য ফ্যাকাসে স্পন্দনহীন দেহ। এটা নিশ্চিত যে এই দেহে আর কোনদিন প্রানের স্পন্দন দেখা দেবে না। কিন্তু এই অমানবিক, বিবেকহীন ভারতবর্ষের বুকে কবে সৌহার্দ্য, মানবিকতার স্পন্দন দেখা যাবে সেই বিষয়ে কোন নিশ্চয়তা নেই। হয়তো ঠিক এইভাবেই আগামীদিনেও রক্তের রং গাঢ় লাল থেকে হয়ে যাবে ফ্যাকাসে।
Comments