top of page

প্রাকৃতিক মানবধর্মের সাফকথা।

-মিলন সিংহ


স্রষ্টা এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করলেন। সৃষ্টি করলেন নক্ষত্র, গ্রহ, উপগ্রহ। পৃথিবীকে সাজালেন প্রাণ সৃষ্টির উপযুক্ত করে। পৃথিবীতে বাতাস বইল, বৃষ্টি ঝড়ল, সূর্যের উত্তাপ পৌঁছাল। বাতাসে মিশল অক্সিজেন। তৈরী হল সমুদ্র, নদী, পাহাড়, ঝরণা। তারপর এককোষী প্রাণী। এককোষ ভেঙে বহুকোষ। উদ্ভিদ, জীব ও মানুষ। প্রত্যেকের জীবনধারণের প্রয়োজনীয় উপকরণের সমাহার – খাদ্য,পানীয়। বংশবৃদ্ধির উপায় ও তাগিদ। কোটি কোটি বছর ধরে যখন সৃষ্টির আসল এই কর্মকাণ্ডগুলি চলছিল, যার অন্তিম ফলরূপে সৃষ্টি হয়েছিল মানুষের তখন সৃষ্টির সেই কয়েক শতকোটি বছরে কতজন ফরিস্তা, দেবদূত, পয়গম্বর জন্মেছিল পৃথিবীতে? কোটি কোটি বছর উদ্ভিদ ও জীব এই পৃথিবীতে বেঁচে থেকেছে, জীবন উপভোগ করেছে, বংশবৃদ্ধি ঘটিয়েছে সে কোন দেবদূত, ফরিস্তা বা পয়গম্বরের নির্দেশিত পথে? ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির মহাযজ্ঞে কতজন পয়গম্বেরর সাহায্য প্রয়োজন হয়েছিল সৃষ্টিকর্তা ঈগল্লার? লক্ষ লক্ষ বছর মানুষই বা দিব্যি বেঁচে-বর্তিয়ে থেকেছে কোন ধর্মপ্রবক্তার ধর্মে দীক্ষিত হয়ে?

চোখ, কান, নাক, হাত, পা, পাকস্থলী, যকৃত, হৃৎপিণ্ড - তোমার প্রয়োজনীয় প্রতিটি অঙ্গ তোমার শরীরে উপযুক্ত স্থানে স্থাপিত হোল। ক্ষুধার খাদ্য, তৃষ্ণার বারি, ক্লান্তির নিদ্রা, মায়ের আদর কোন পয়গম্বর, কোন ফরিস্তা, কোন অবতার পৃথীবাতে আবির্ভূত হয়ে মানুষের জন্য বয়ে এনেছিল? তারপর হঠাৎ গত মাত্রই হাজার দুই-আড়াই বছর ধরে স্রষ্টার কি এমন প্রয়োজন পড়ল যে তিনি পৃথিবীতে একের পর এক পয়গম্বর, অবতার, ফরিস্তা প্রেরণ করতে শুরু করলেন? স্রষ্টা কি জড়-বার্ধক্যে উপনীত হয়েছেন? সৃষ্টি কার্য রক্ষা করতে অক্ষম হয়েছেন? তাই তিনি সহকারী নিয়োগের বন্দোব্যস্ত করলেন? জন্ম-মৃত্যু রহিত ঈগল্লার বার্ধক্য? সর্বশক্তিমানের অক্ষমতা? সয়ম্ভুর সহকারী?

যিনি তাঁর নির্দিষ্ট স্থানে উপবিষ্ঠ থেকে সূর্য, তারকা থেকে শুরু করে পৃথিবী, প্রকৃতি উদ্ভিদ জীব ও মানুষ সৃষ্টি করতে পারেন, আজও বৃহৎ এই ব্রহ্মাণ্ডকে পরিচালিত করতে পারেন একক ক্ষমতায়, সেই তিনি মানুষকে স্বয়ং পরিচালনা করতে ব্যর্থ হয়ে পয়গম্বর, দেবদূত, ফরিস্তাদের পাঠালেন মানুষের জন্য ধর্ম প্রচার করতে? তিনি স্বয়ং এইকাজের আর উপযুক্ত রইলেন না? মানুষের উপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ রাখতে তিনি কি অপারগ হয়ে পড়লেন?

ব্যাঙাচির লেজ খসাতে ব্যাঙ-মাকে আজও কোন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম অনুসরণ করতে হয় না, যেমন হয় খাতনা করতে। পুরুষের গোঁফ গজাতে কিংবা নারীর রজঃস্বলা হতে প্রয়োজন পড়ে না কোন মন্ত্রপাঠের, যেমন হয় বিবাহে।

তাহলে এই এত এত পয়গম্বর, ফরিস্তা, দেবদূত এরা কারা? যারা প্রত্যেকে পৃথক পৃথক ধর্ম প্রচার করে মানুষকে নানা ধর্মে বিভক্ত করে মানুষের সর্বনাশ করতে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন?

এরপরও যারা স্বঘোষিত ফরিস্তা, পয়গম্বর, দেবদূতে বিশ্বাস করবে কর। প্রাকৃতিক মানবধর্মের কর্ণে প্রতিনিয়ত ধ্বনিত হচ্ছে সেই বাণী, “আমি কখনও কোন পয়গম্বর, ফরিস্তা বা দেবদূত প্রেরণ করি না। আমি সর্বশক্তিমান, আমি স্বয়ম সম্পূর্ণ। ”

অধর্ম করলে পাপ হয়। পাপে মৃত্যু। মহাপাপে সবংশে ধ্বংস। তাহলে ধর্ম কি, অধর্মই বা কি?

কেউ যদি গীতা না পড়ে, কোরাণ ছুঁড়ে ফেলে, বাইবেল পুড়িয়ে দেয় তাতে তার কোন কষ্টও হবে না, মৃত্যুও হবে না। কিন্তু কেউ যদি শ্বাসগ্রহণ না করে, খাদ্যগ্রহণ না করে, জলপান না করে? প্রথমে সে কষ্ট পাবে, তারপর তার মৃত্যু হবে। প্রথমক্ষেত্রে কষ্ট হয় না, মৃত্যু তো নয়ই। দ্বিতীয়ক্ষেত্রে কেন কষ্ট ও তারপর মৃত্যু হয়? কেন না, প্রথম ক্ষেত্রে সে কোন পাপ করে না কিন্তু দ্বিতীয়ক্ষেত্রে সে পাপ করে। সেই পাপেই তার কষ্ট ও মৃত্যু হয়। প্রথমক্ষত্রে কোন পাপ হয় নাই, কারণ সেখানে কোন অধর্ম হয় নাই। দ্বিতীয়ক্ষেত্রে অধর্ম হয়েছে তাই পাপ হয়েছে। অর্থাৎ শ্বাসগ্রহণ, খাদ্যগ্রহণ ও জলপান না করে সে অধর্ম করেছে। সেই অধর্মেই তার পাপ হয়েছে। অর্থাৎ, গীতা না পড়লে, কোরাণ ছুঁড়ে ফেললে কিংবা বাইবেল পুড়িয়ে দিলে কোন অধর্ম হয় না। তেমনি অধর্ম নয় মন্দির, মসজিদ, গীর্জা বা গুরুদ্বারায় না যাওয়াও। সারা জীবন মন্দিরে না গেলেও কেউ মরবে না। কিন্তু শ্বাসগ্রহণ, খাদ্যগ্রহণ কিংবা জলপান না করলে, বিষপান করলে অধর্ম হয়।

অর্থাৎ মনু, শঙ্করাচার্য, হজরত, যীশুখ্রীষ্ট, বুদ্ধ স্বয়ং-স্রষ্টার বাণী বলে যা প্রচার করে গিয়েছেন তা ধর্ম নয়।

তাহলে ধর্ম কি?

শ্বাসগ্রহণ, খাদ্যগ্রহণ, জলপান, আত্মরক্ষা ইত্যাদি প্রাকৃতিক নিয়ম মেনে চলা। প্রাকৃতিক হয়ে বাঁচা। যাকে বলি প্রাকৃতিক ধর্ম। প্রাকৃতিকধর্মেই তুমি জন্মেছ, বেঁচে রয়েছ। প্রাকৃতিকধর্মের নিয়মেই তুমি মরবে। জন্ম-জীবনযাপন-মৃত্যু অর্থাৎ, সৃষ্টি-স্থিতি-লয় – প্রাকৃতিকধর্মই এই তিনের কর্তা।

এ তো গেল খুচরো পাপ। এবার আসি মহাপাপের কথায়। যে পাপে সবংশে ধ্বংস হতে হয়। কখন কেউ সবংশে ধ্বংস হয়? বিধবা আমিষ খেলে কিংবা তিন ওয়াক্ত নমাজ না পড়লে? মহাপাপ তো নয়ই, এতে খুচরো পাপও হয় না। মানুষ খুন করলেও কেউ সবংশে ধ্বংস হয় না। মানুষ খুন করাও মহাপাপ নয়। কিন্তু যখন কেউ প্রাকৃতিক দেহজ-কামকে ইন্দ্রিয় পরায়ণতা ও তাজ্য ভেবে ব্রহ্মচর্য্য পালন করে তখন সে মহাপাপে পাপী হয়। এই পাপে তার বংশরক্ষা হয় না, সে সবংশে ধ্বংস হয়।

সুতরাং, কেউ যখন স্রষ্টার সংবিধান-স্বরূপ প্রাকৃতিক নিয়মগুলিকে অবহেলা করে বা ত্যাগ করে তখনই সে পাপ করে এবং যৌনপ্রবৃত্তি ত্যাগ করলে মহাপাপ করে।

প্রাকৃতিক মানবধর্মে জৈবপ্রবৃত্তিগুলির যথাযথ পালন না করাকে পাপ ও প্রাকৃতিক দেহজ-কামবাসনাকে ঘৃণা করা মহাপাপ।

ত্যাগবাদী বলেন – এই জগৎ অনন্ত দুঃখময়, ইহাতে প্রকৃত সুখের লেশও নাই। যাহা আছে তাহাও ক্ষণিক। সুতরাং সেই সুখ ও তাহার সাধন ত্যাগ করে কৃচ্ছ সাধন কর। ত্যাগে মোক্ষলাভ ও অনন্ত স্বর্গবাস হয়।

কিন্তু ওহে ত্যাগবাদী, তুমি যে ইহজগতকে দুঃখময় ও প্রপঞ্চময়, ইহজগতের সুখকে ক্ষণিক ও মায়া বলে সেই ভোগ-সুখে সময় নষ্ট না করে কৃচ্ছ সাধন কর সে কিসের জন্য? মোক্ষ ও স্বর্গলাভের জন্যই তো? অর্থাৎ, আরও বৃহৎ ও অনন্ত সুখলাভের লোভে। তাহলে ভোগলিপ্সা কার প্রবল? ইহজগতে ক্ষুদ্র জীবনকালে যেটুকু সুখ পাওয়া যায় তাই ভোগ করে যে তৃপ্ত হয় তার, না অনন্ত স্বর্গসুখের লোভে লালায়িত হয়ে যে ইহজগতে ত্যাগের মাধ্যমে কৃচ্ছসাধন করে তার? আসল ভোগবাদী তাহলে কে?



0 comments

Recent Posts

See All

Comments


bottom of page