-কুসুমকলি দে
১৭ই ফেব্রুয়ারি ১৬০০
সাত বছর কারারুদ্ধ থাকার পর আজ তাঁর চূড়ান্ত শাস্তি ভোগ করার দিন। ইতালির Campo De'Fiory স্কোয়ার। অগণিত মানুষের সমাগম হয়েছে আজ সেখানে। সকলের মধ্যে আজ উৎকণ্ঠা,কত বড় একজন আসামির সাজা হবে আজ! গির্জার ধর্মযাজকদের দয়ার শরীর, তারা নিষ্ঠুর থেকে নিষ্ঠুরতম অপরাধীদের ও ক্ষমা করে দেন। চুরি,ডাকাতি,খুন খারাপি যাই করে থাকুক না কেন,সকল অপরাধই ক্ষমারযোগ্য শুধু যদি শেষে দোষীরা নিজেদের দোষ শিকার করে গির্জা কর্তৃপক্ষের কাছে মাপ চেয়ে নেয়। কিন্তু এই তরুণ অসম্ভব জেদি, কিছুতেই তাকে নিজের অবস্থান থেকে টলানো গেল না। রোমান ইনকুইজিশনের ইনকুইজিটর কার্ডিনাল বেলারমাইন তাকে তাঁর ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাইতে বলেছিলেন, কিন্তু সে অস্বীকার করে। ১৬০০ সালের ২০ জানুয়ারি পোপ ৮ম ক্লেমেন্ট তাকে একজন ধর্মদ্রোহী বলে তাকে আখ্যায়িত করেন ও তাঁকে মৃত্যুদন্ডের রায় দেন। রায় শুনে আসামি বিচারকদের শাসিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, “আপনারা হয়তো আমার সাথে হেরে যাবার ভয়ে আমার বিরুদ্ধে এই রায় দিয়েছেন। আমি এটি গ্রহণ করলাম।’’ তরুণটির নাম জিওর্দানো ব্রুনো। তাঁর অপরাধ রোমের ক্যাথলিক গির্জার বিরুদ্ধাচারণ করা। বাইবেলে বর্ণিত মহাবিশ্বের ব্যাখ্যা মানতে অস্বীকার করেছিলেন। বাইবেলের বর্ণনার প্রকাশ্যে বিরোধিতা করা সেই প্রথম ব্যাক্তিই ব্রুনো। তাঁর মত ছিল মহাবিশ্ব একাধিক ও তার কোনো কেন্দ্র নেই। নিষিদ্ধ করে দেওয়া কোপারনিকাসের মত-পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘোরে, সমর্থন করেছিলেন এবং প্রচার করেছিলেন। তাই মৃত্যুদণ্ড। সকলের চোখের সামনে পিছমোড়া অবস্থায় প্রথমে তার জিভ কেটে ফেলে তারপরে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হল।
এই নৃশংসতার মাধ্যমে গির্জা কর্তৃপক্ষ এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চেয়েছিলেন যারা যারা স্বাধীন ভাবে চিন্তা করবে, ধার্মিক মতাদর্শের বিরোধিতা করবে তাদের সকলের এমন ভাবে কন্ঠরোধ করে দেওয়া হবে। এমন এক রাজত্ব যেখানে একছত্র অধিপত্যে সম্ভব। অন্যায় ভাবে মানুষকে পেশীর বল, কখনও ঈশ্বরের ভয় দেখিয়ে উৎপীড়ন করা সম্ভব হবে।
কিন্তু শত চেষ্টা সত্ত্বেও স্তব্ধ করা যায়নি বিজ্ঞানের গতিকে। এমন কোন কারাগার, কোন শাসকই তৈরি করতে পারেনি যা বৈজ্ঞানিক চিন্তাকে, যুক্তিকে রুদ্ধ করতে পারে। ব্রুনোর মৃত্যুর পর তার কাজকে অনুসরণ করে এগিয়েছেন বহু অনুসন্ধিৎসু, কৌতূহলী মানুষ। সেই কৌতূহল,অদম্য সাহসই চালিত করেছে আমাদের এই বিশ্বের কত গোপন রহস্য উদঘাটন করতে। আজ বিজ্ঞানের কত সুবিধা আমরা উপভোগ করছি কিন্তু এই পথচলার শুরুটা ছিল এমনই কঠিন, প্রতিপদে বিরোধিতা।
এবার প্রশ্ন আসে মনে এই একবিংশ শতাব্দীতে এই ঘটনাগুলির তাৎপর্য ঠিক কী? আমরা হয়তো আজ আধুনিক হয়েছি। গোটা পৃথিবী জুড়ে আজ বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা প্রচুর হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায় আমরা কী সত্যিই একাত্ম হতে পেরেছি বৈজ্ঞানিক মতাদর্শের সাথে। সমাজের সর্বস্তরে কী পৌঁছতে পেড়েছে যুক্তির আলো? অনেক শিক্ষিত মানুষের চিন্তাভাবনার মধ্যেও চোখে পড়ে অন্ধবিশ্বাস, অবৈজ্ঞানিক চিন্তা,কারণ সত্যেকে অনুধাবন করা অনেক কঠিন। সেই তুলনায় অন্য কারুর চিন্তাকে নিজের চিন্তা বলে চালানো সহজ।বিজ্ঞান অনেক বেশি নমনীয়।বিজ্ঞানের চোখে সকলে সমান। কোন ভুল ত্রুটি থাকলে তা শুধরে নেওয়া হয়েছে। ধর্মমত আর রাজনীতিক মতের সত্যতা প্রমাণ করা অসাধ্য।প্রমাণের অভাবে আসে আক্রোশ আর উওেজনা, মতবিরোধের ফল হয় শত্রুতা। রাজশেখর বসু তাঁর 'বৈজ্ঞানিক বুদ্ধি' রচনাটিতে লিখেছেন -"যদি বৈজ্ঞানিক বুদ্ধি সমাজের সকল মানুষ প্রয়োগ করতে শেখেন তবে কেবল ভ্রান্ত সংস্কার দূর হবে না, ধর্মান্ধতা ও রাজনৈতিক সংঘর্ষের ও অবসান হবে।"
সেইদিন তাঁর যোগ্য সম্মান দিতে পারব আমরা ব্রুনোকে। ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন ব্রুনো। বিজ্ঞানের ইতিহাসে প্রথম শহীদ।
Comments