-কুসুমকলি দে
“ছি ছি, কি দিনকাল পড়ল বলুনতো! এও কি দেখা বাকি ছিল? “বাসে আমার পাশে বসা দুজন মধ্যবয়স্কা কাকিমা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিলেন। দুজনকে দেখেই মনে হল সম্ভ্রান্ত পরিবারের। “এত দোষে যেন কুলোচ্ছিল না, মেয়েরা আরও বেহায়া হয়ে গিয়েছে। একেবারে ঋতুস্রাব নিয়ে খোলাখুলি কথা, খোলাখুলি আলোচনা করছে! যা তোদের লুকিয়ে রাখার কথা, যে কথা শুনলে কান অবধি গঙ্গাজল দিয়ে ধুয়ে নেওয়ার কথা, সে বিষয়ে জিভ দিয়ে আলোচনা করছিস! জানিস না জিভে সরস্বতীর বাস” (তিনি দেবতা-মেয়ে, তাই বোধ হয় ঋতুমতী হন না) শুনতে পেলাম একজন বলছেন তাদের মধ্যে। “ঠাকুর ঠাকুর রক্ষা কর, এ ঘোর কলিকাল”,বলে করজোড়ে কপালে ঠেকালেন অন্যজন।
২০১৯ সালে যখন ছোট ছবি ‘পিরিয়ড। এন্ড অফ সেনটেন্স। ’ অস্কার জিতল, সারা দেশ জুড়ে ধন্য-ধন্য রব উঠল অস্কারবিজয়ী বলে কথা! একটু ধামাকা না হলে কি হয়? কিন্তু এই ধামাকা, তোপধ্বনি কি সত্যিই পৌঁছল সেইসব মানুষের কানে, যাদের কাছে ‘পিরিয়ড’ মানে অসুখ! ‘পিরিয়ড’ মানে অপবিত্রতা! ‘পিরিয়ড’-এর অর্থই যারা ঠিক মতো বোঝেন না। 'রজঃস্রাব' বা 'পিরিয়ড' ক্ষুধা-নিদ্রার মতোই স্বাভাবিক। আদৌ রোগ নয়— কিন্তু তার ডাকনাম ‘শরীর-খারাপ’। আড়ালের নাম ‘মাসিক’। স্যানিটরি ন্যাপকিন বাজারে আসা তো এই সেদিন, বড় জোর বছর পঞ্চাশ। আর মোটের উপর পরিচিত আর সুলভ হওয়া তো বড় জোর তিন দশক। খারাপ শরীর সামলানোর উপায় ছিল বাড়তি বাতিল কাপড়ের টুকরো। চলতি কথায় ‘ন্যাকড়া’। শুধু দিন-আনা দিন-খাওয়া হতদরিদ্র পরিবারগুলিতে নয়, মধ্যবিত্ত এমনকী উচ্চবিত্ত পরিবারেও মাসিকের জন্য ব্যবহৃত বস্ত্রখণ্ড এক বারের পর ফেলে দেওয়া যেত না, সেটিকে কেঁচে-শুকিয়ে পুনর্ব্যবহারের যোগ্য করে নিতে হত। শুকোতে দিতে হত গোপনে, বড় বহরের ধুতি, শাড়ি বা চাদরের তলায়। একটা অস্বস্তি নিয়েই থাকতে হত মেয়েদের, রজঃস্বলাদের। অনেক কিছুর মতোই লাজ-লজ্জার জগতেও দ্রুত বদল শুরু হল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে। বিপুল সংখ্যক নার্স এবং স্বেচ্ছা-সেবিকা হিসেবে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত সম্ভ্রান্ত মহিলাদের এত জবরজং উপকরণ ব্যবহারের উপায় রইল না। এই সময়েই বিভিন্ন কোম্পানি আজকের ‘স্যানিটরি ন্যাপকিন’ নামে পরিচিত পণ্যটিকে বাজারে আনে। ন্যাপকিনের এইসব আদিরূপের মধ্যে একটি ছিল ‘SHAG-NA-KINS’ নামে একটি ব্র্যান্ড।
বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন কুসংস্কার ছড়িয়ে আছে পিরিয়ড কে নিয়ে। অনেক ক্ষেত্রে সেগুলো প্রাণঘাতীও বটে। যেমন নেপালে চৌপদী নামক একটি প্রথা আছে। মাসিকের সময় একটি আলাদা ছোট কুটিরে থাকতে হয়, মেয়েটিকে অপবিত্র মনে করা হয় তখন। অনেক সময় দমবন্ধ হয়ে অথবা অসম্ভব ঠান্ডায় অনেকে বলি হয়েছেন এই প্রথার। আমাদের সমাজেও সমস্ত সামাজিক অনুষ্ঠানে যাওয়া বা কোন শুভানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার ওপর অনেক নিষেধাজ্ঞা রয়েছে অনেক পরিবারে। কেবল প্রত্যন্ত গ্রামের দিকে নয় শহরেও মেয়েরা ঋতুকালীন পরিচ্ছনতার অভাবে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হন। আজ মহিলাদের আড়াল প্রায় নেই, তাঁরা অধিকাংশই আর অন্তঃপুরের নন। কিন্তু আড়ালের ওই শব্দগুলোর আব্রু যেন ঘুচতে গিয়েও ঘোচবার নয়। নারীর অনিবার্য শরীরধর্ম রজঃস্রাব ঘিরে রয়ে গিয়েছে আদিমতম কিছু নিষেধাজ্ঞা। কোষ্ঠ-কাঠিন্যের জন্য জোলাপ বিক্রি হয় প্রকাশ্যে, কিন্তু কন্ডোম আর স্যানিটরি ন্যাপকিন এখনও কাগজে জড়িয়ে নিতে হয় কাউন্টার থেকে।
একটা প্রশ্ন প্রায়ই জাগে মনে। রনো কত স্মৃতি,কত সুঅভ্যাস সময়ের সাথে সাথে হারিয়ে ফেলি আমরা। কিন্তু বস্তাপচা ধারণা,যুগের পর যুগ চলেই আসছে। কুসংস্কারের বীজ আর কতদিন আমরা বপন করে যাব এই সমাজের বুকে?হ্যাঁ মানছি, এখন অনেক প্রচার হয় এইসবের বিরুদ্ধে। টিভি,ইন্টারনেটে বড় বড় অনেক বিজ্ঞাপনই চোখে পড়ে। কিন্তু নিজের চারপাশে,নিজের পরিবারের মধ্যেই, একবার ভালো করে খেয়াল করবেন, খুব বেশি পরিবর্তন চোখে পড়বে না। আমরা পোশাক আর দৈনন্দিন জীবনে কেবল আধুনিকতার ছোঁয়া থাকলেই হবেনা নিজেদের চিন্তাভাবনাতেও আনা চাই স্বচ্ছতা,যৌক্তিকতা। কেবল এই একটি ক্ষেত্র নয়। জীবনকে অন্য কারুর নয় নিজের মতো করে বাঁচুন। নিজের যুক্তি, বুদ্ধি দিয়ে সব ঘটনাকে বিশ্লেষণ করুন।
ধুমধাম করে আলাদা একটা দিন নারী দিবস হিসেবে পালন না করে যদি সঠিক শারীরিক শিক্ষার পাঠ পড়াতে পারি এই সমাজকে তাহলে হয়তো নারী পুরুষ ভেদাভেদ দূর করে কাঁধে কাঁধ মিলেয়ে এই সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সফল কান্ডারী হয়ে উঠতে পারব আমরা।
Comments