top of page

ইঞ্জিনিয়ারিং ইতিকথা


-সৌরভ দেবনাথ


ইঞ্জিনিয়ারিং বা প্রযুক্তিবিদ্যা বর্তমানে বিজ্ঞানের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। যদিও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের সাথে এর সামান্য পার্থক্য আছে। ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পূর্ণ ভাবেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু ব্যাপারটা সবসময় তেমন ছিলনা। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির আগে প্রযুক্তিবিদ্যা ছিল ঠেকে শেখার মত। প্রয়োজনের তাগিদ সবথেকে বড় তাগিদ। তাই গুহামানবদের ব্যবহৃত অস্ত্র থেকে কারিগরিবিদ্যার ছাপ স্পষ্ট বোঝা যায়। চাকার ব্যবহার হলো এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ যা মানবসভ্যতাকে অবিশ্বাস্য গতিতে এগিয়ে দিয়েছে। এরপর আমরা দেখতে পাই প্রাচীনতম সভ্যতার কিছু নিদর্শন যা আমাদের বিস্মিত করে। মিশরের পিরামিড, পেরুর মাচুপিচু, ইস্টার দ্বীপের বৃহৎ সব মূর্তি, ভারতের চাঁদ বাওরি, রোমান স্থাপত্য, বন্যা রোধের জন্য মিশরের বাঁধ, রোমান জলাধার আরো অসংখ্য সব নিদর্শন। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো জ্যামিতি ও ত্রিকোণমিতির ব্যবহার অনেক আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। তাই এই সকল নিদর্শন যতই মানুষের দ্বারা অসম্ভব মনে হোক না কেনো (কিছু কিছু ষড়যন্ত্রতত্ত্বকারীদের মতে ভিনগ্রহীদের সাহায্যে এইসব বানানো হয়েছে) তা মানুষের কারিগরিবিদ্যার ফসল।

গ্যালিলিওকে বলা হয় আধুনিক বিজ্ঞানের জনক। সবকিছু পরীক্ষা দ্বারা যাচাই করার কথা তিনি বলতেন। তাঁর বানানো দূরবীন যখন তিনি রাতের আকাশের দিকে ফেরালেন সেটাই ছিল সম্ভবত বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষার শুরু। এরপর ধীরে ধীরে নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র, গতির সূত্র এছাড়া আরো অনেক বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের আবির্ভাব হতে লাগলো। বিজ্ঞানকে বলা হতো প্রাকৃতিক দর্শন। এরপর থেকেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে ইঞ্জিনিয়ারিং গতি লাভ করে। ১৭৬০ এর সময় থেকে ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের সূচনা হয়। বিভিন্ন কলকারখানা গড়ে ওঠে। তার সাথে প্রয়োজন হয়ে পড়ে দ্রুত অনেক বেশি পরিমাণে কাঁচামাল আমদানি ও উৎপাদিত দ্রব্য রপ্তানির। এছাড়া কম বিনিয়োগে বেশি লাভের আশা দেখতে শুরু করে কারখানার মালিকরা। প্রয়োজন হয় ইঞ্জিনিয়ারদের। বাষ্পীয় শক্তিকে কাজে লাগিয়ে থমাস নিউকোমেন বানালেন বাষ্পীয় ইঞ্জিন। সেই ডিজাইন উন্নত করলেন জেমস ওয়াট। সেই শুরু ইঞ্জিনিয়ারদের হাতে সভ্যতার অগ্রগতি। এরপর জর্জ স্টিফেনসন ও তাঁর পুত্র রবার্ট স্টিফেনসন যাত্রীবাহী রেল ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। রকেট নামক লোকোমোটিভ ছিল তখনকার দ্রুততম যানবাহন। এগুলো সবই মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ফল। এই ক্ষেত্রে যাঁদের কথা না বললেই নয় তাঁরা হলেন রুডলফ ডিজেলের ও নিকোলাস অটো। ডিজেল ইঞ্জিন ও পেট্রোল ইঞ্জিনের নাম আমরা সবাই মোটামুটি জানি। ডিজেল ও পেট্রোল ইঞ্জিনের উদ্ভাবক যথাক্রমে রুডলফ ডিজেল ও নিকোলাস অটো। এই দুই ইঞ্জিনকে বলা হয় ইন্টারনাল কম্বাশন ইঞ্জিন। অর্থাৎ জ্বালানী দহন করে তার দ্বারা উৎপন্ন গ্যাস পিস্টনকে ঠেলে দেয়। জার্মান উদ্ভাবক কার্ল বেঞ্জ ইঞ্জিনের ব্যবহার করে তৈরি করলেন প্রথম মোটরগাড়ি।

আমাদের বর্তমান সময়ে বিদ্যুৎ অপরিহার্য। কয়েক মিনিট বিদ্যুৎ ছাড়া কল্পনা করাও দুঃসাধ্য। হৃৎপিণ্ড যেমন সারা শরীরে রক্ত সরবরাহ করে এবং তা ব্যাহত হলে শরীর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে বিদ্যুৎ ব্যবস্থাও যেন সেরকম। বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ব্যাহত হলে জনজীবন থমকে যাবে। বর্তমানে আমরা যে বিদ্যুৎ ব্যবহার করি তা হলো এ.সি. বিদ্যুৎ। এই বিদ্যুৎ ব্যবস্থারও একটা ইতিহাস আছে যা 'কারেন্ট ওয়ার ' নামে খ্যাত। সারা পৃথিবীতে এই বিদ্যুৎ ব্যবস্থা যাঁরা নিয়ন্ত্রণ করছেন তাঁরা হলেন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। তাঁদেরও একটা ইতিহাস আছে। প্রাচীন গ্রিকরা পশম ও অ্যাম্বার একে অপরের সাথে ঘষে দেখেছিল দুটি বস্তু পরস্পরকে আকর্ষণ করছে। এটি ছিল স্থির তড়িৎ। এরপর প্রায় দুই হাজার বছর পর একই ঘটনা লক্ষ্য করেন রানী এলিজাবেথের ডাক্তার উইলিয়াম গিলবার্ট। এরপর ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে ইতালির পদার্থবিজ্ঞানী আলেসান্দ্রো ভোল্টা প্রথম তড়িৎকোষ বানালেন। সালফিউরিক অ্যাসিডে তামা ও দস্তার পাত দিয়ে বানালেন প্রথম ব্যাটারি যা ছিল রাসায়নিক শক্তিকে তড়িৎ শক্তিতে রূপান্তর। এরপর মাইকেল ফ্যারাডে দেখলেন তার কুণ্ডলীর মধ্য দিয়ে চুম্বক নিয়ে গেলে গ্যালভানোমিটারের কাঁটা নড়ে উঠছে। সেই ছিল বৈদ্যুতিক জেনারেটর তৈরির প্রথম ধাপ। এছাড়াও বৈদ্যুতিক মোটরের ধারণাও তিনিই প্রথম দেন। এছাড়াও তড়িৎ ও চুম্বকত্ব একে অন্যের পরপূরক তা তিনিই প্রথম বলেন। কিন্তু রয়্যাল সোসাইটি প্রথমে মেনে নেয়নি। তার উদ্ধারকারী হিসেবে এলেন জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল। যিনি গাণিতিক সমীকরণের সাহায্যে দেখালেন ফ্যারাডের তত্ত্বকে। ফ্যারাডের শিক্ষক স্যার হামফ্রে ডেভি ভোল্টাইক কোষ দিয়ে আর্ক ল্যাম্প বানানোর প্রচেষ্টা করেন। কিন্তু তা ছিল প্রচুর উজ্জ্বল ও ক্ষণস্থায়ী। এরপর আমেরিকান উদ্ভাবক টমাস আলভা এডিসন দীর্ঘস্থায়ী বৈদ্যুতিক বাতি বানালেন। তিনি কয়লাশক্তি পরিচালিত বিদ্যুৎ ব্যবস্থাও বানালেন। এই বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ছিল ডি.সি বা ডাইরেক্ট কারেন্ট। কিন্তু ডি.সি ব্যবস্থায় অসুবিধা হলো তড়িৎ পরিবাহীর প্রস্থছেদ অনেক বেশি হতে হবে এবং তা খুব বেশি দূর পর্যন্ত তড়িৎ পরিবহনে অক্ষম। সেই সময় মাঠে নামলেন আরেক ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার জর্জ ওয়েস্টিংহাউস। তিনি তার এ.সি বা অল্টারনেটিং কারেন্ট ব্যবস্থা প্রসারে বদ্ধ পরিকর। পরবর্তীকালে তিনি পাশে পেয়েছিলেন এডিসনের জেনারেল ইলেকট্রিক ত্যাগ করা সাইবেরিয়ান ইঞ্জিনিয়ার নিকোলা টেসলাকে। নিকোলা টেসলা তিন ফেজের বৈদ্যুতিক ব্যবস্থার জনক। তাছাড়া তিন ফেজের বৈদ্যুতিক মোটর ও এক ফেজের বৈদ্যুতিক মোটর উদ্ভাবন করেন। এই এ.সি বিদ্যুতের সুবিধা হলো উৎপাদন কেন্দ্র থেকে বহু দূরে বিদ্যুৎ প্রেরণ করা যায় বিদ্যুৎ অপচয় কম করে ও স্বল্প প্রস্থের তার ব্যবহার করে। ট্রান্সফরমার যন্ত্রের সাহায্যে ইচ্ছে মত ভোল্টেজ বাড়ানো বা কমানো যায়। এই টেসলার জন্যই ওয়েস্টিংহাউস কারেন্ট যুদ্ধে জিতে যান যার ফল স্বরূপ এখনো এ.সি ব্যবস্থাই আমরা দেখতে পাই।


ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর দৌলতে আরেকটি বিভাগ একটু একটু করে বাড়তে থাকে যা হলো কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং। বহুদূরে যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রাথমিক পদ্ধতি ছিল চিঠি আদান প্রদান। তারের মধ্য দিয়ে তড়িৎ পরিবহনকে কাজে লাগিয়ে তৈরি হলো টেলিগ্রাফ। চার্লস হুইটস্টোন প্রথম বৈদ্যুতিক টেলিগ্রাফ পেটেন্ট করান। আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল উদ্ভাবন করলেন টেলিফোন। ম্যাক্সওয়েল লক্ষ্য করেছিলেন পরিবর্তনশীল তড়িৎক্ষেত্র ও পরিবর্তনশীল চৌম্বকক্ষেত্র একে অপরের উৎপাদনের জন্য দায়ী। এই পরিবর্তন তরঙ্গের আকারে একটি নির্দিষ্ট গতিতে উৎস থেকে ছড়িয়ে পড়ে যা আলোর গতির সমান। বিজ্ঞানের জগতে এ এক যুগান্তকারী আবিষ্কার। বিজ্ঞানের আলাদা দুই তত্ত্বকে (আলো ও তড়িৎচুম্বকত্ব) এক সূত্রে গেঁথে দিলেন। একদিকে যেমন আপেক্ষিকতাবাদের ভিত্তি স্থাপন করলেন অপরদিকে খুলে দিলেন যোগাযোগ ব্যবস্থার দুয়ার। প্রথমে তা গণিতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। জার্মান বিজ্ঞানী হেনরিক হার্জ প্রথম খুঁজে পেলেন তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ। মানব সভ্যতা আয়ত্ত করলো ব্রহ্মাণ্ডের সর্বোচ্চ গতি, আলোর গতি। মার্কনি অ্যান্টেনা বানিয়ে আটলান্টিকের পেরিয়ে রেডিও তরঙ্গ পাঠাতে সক্ষম হলেন।

বর্তমানে জটিল সব গাণিতিক সমাধান দ্রুত সম্ভব হচ্ছে ক্যালকুলেটরের দৌলতে। এছাড়া বিজ্ঞানের সকল গণনা, সিমুলেশন সব সম্ভব হয়েছে কম্পিউটার বিজ্ঞানের জন্য। এছাড়াও বর্তমান ল্যাপটপ, মোবাইলের শক্তিশালী প্রসেসরের বাহারী সব নাম আমরা শুনতে পাই সেই সবই সম্ভব হয়েছে ট্রানজিস্টর নামক যন্ত্রের আবিষ্কারের জন্য। এই ট্রানজিস্টর আবিষ্কারের আগে যে যন্ত্র ব্যবহার হতো তা হলো ভ্যাকুম টিউব। এই ভ্যাকুম টিউবের আরেকটি ব্যবহার হলো বৈদ্যুতিক সংকেত বর্ধিত করা। কিন্তু তাতে প্রচুর বৈদ্যুতিক শক্তিক্ষয় হতো। ১৯৪৮ সালে জন বারডিন, উইলিয়াম শকলে ও ওয়াল্টার ব্র্যাটেন আবিষ্কার করেন ট্রানজিস্টর। ১৯৫৬ সালে তিনজনই নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। এরপর বৈদ্যুতিক বর্তনী অনেক ছোট এবং কম বৈদ্যুতিক ক্ষমতা সম্পন্ন বানানো সম্ভব হয়েছে। এরপর জ্যাক কিলবি তৈরি করেন ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট। ধীরে ধীরে ট্রানজিস্টরের আকার ছোট হতে থাকে। এরপর আমেরিকার ইনটেল কোম্পানি ১৯৭১ সালে বানায় তাদের প্রথম প্রসেসর ইনটেল ৪০০৪। এরপর আরো শক্তিশালী প্রসেসর তৈরি হতে থাকে যার ফসল হিসেবে আমরা দেখতে পাচ্ছি আমাদের অতি দ্রুত গণনক্ষমতাসম্পন্ন স্মার্টফোন, ল্যাপটপ।

১৯০৩ সালে রাইট ভাতৃদ্বয় প্রথম আকাশে ওড়েন। সেই ছিল প্রথম বিমান আবিষ্কার। এর মাত্র ৬৬ বছর পর ১৯৬৯ সালে নাসা প্রথম চাঁদের মাটিতে মানুষ পাঠাতে সক্ষম হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে ত্বরণ প্রদান করেছিল। কিন্তু এতসব কিছুই সম্ভব ছিলনা ইঞ্জিনিয়ারদের ছাড়া। দৈনন্দিন আরামদায়ক জীবনের কথা বাদ দিলেও বর্তমানে বিজ্ঞানের গভীর কিছু প্রশ্ন যেমন মহাবিশ্বের উৎপত্তি, মহাকাশ গবেষণা এইসব কোনো কিছুই ইঞ্জিনিয়ারদের ছাড়া সম্ভব নয়। ১৯৯০ তে নাসা মহাকাশে পাঠায় হাবল স্পেস টেলিস্কোপ। এখনো পর্যন্ত এটা থেকে প্রায় ষোলো হাজার রিসার্চ পেপার বের হয়। ২০১৫ তে আবিষ্কার হয় মহাকর্ষীয় তরঙ্গ বা গ্ৰ্যাভিটেশনাল ওয়েভ যা প্রমাণ করল আইনস্টাইনের ভবিষ্যৎবাণী, ২০১৯ সালে আমরা দেখতে পেলাম কৃষ্ণ গহ্বরের ছবি, সার্নের কণা ত্বরণ যন্ত্র তো বিজ্ঞানের জগতে এক দুর্দান্ত আবিষ্কার যা বিজ্ঞানের মৌলিক গবেষণায় অনবদ্য অবদান রেখেছে। আর এই সবকিছুই অসম্ভব রয়ে যেত ইঞ্জিনিয়ারদের ছাড়া। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মূল ভিত্তিই হলো পরীক্ষার দ্বারা যাচাই করা। আর বিজ্ঞানীরা ইঞ্জিনিয়ারদের ওপর পরীক্ষার যন্ত্রপাতির জন্য সম্পূর্ণভাবেই নির্ভরশীল। অপরদিকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ছাড়া ইঞ্জিনিয়ারিং অন্ধের যষ্ঠী ছাড়া পথ চলার মত। তাই বিজ্ঞান ও ইঞ্জিনিয়ারিং একে অন্যের পরিপূরক। একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ।

Recent Posts

See All

Comments


bottom of page