top of page

চলো,এগিয়ে চলি


-সায়ন কর্মকার

আমাদের সমাজব্যবস্থার মূল উপাদান হল মানুষ। আবার এই সমাজে মানুষ বৈচিত্র্যময়। আজ পর্যন্ত সভ্যতা যে এতদূর এগিয়ে এসেছে, সমাজ পাল্টেছে তা পুরোটাই যুক্তির উপর নির্ভর করে। সময় এগোচ্ছে, তার সাথে সাথে আমাদেরও উচিত সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলা, সঠিক মূল্যবোধকে গ্রহণ করা। আর সেই অগ্রগতির ধারা হবে যুক্তিসম্মত চিন্তাধারাকে ধারণ করে। আবেগে গা ভাসানো চলার স্রোতের প্রতিকূলে চিন্তাভাবনা করা কিছু মস্তিস্ক প্রসূত চিন্তাভাবনাই আমাদের সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে চলে। গুটিকতক শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মস্তিষ্ক প্রসূত চিন্তাভাবনাকে যখন আমরা, সাধারণ মানুষ উপলব্ধি করে নিজের জীবনে প্রয়োগ করতে চায় তখন নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। এই প্রতিবন্ধকতা হয় যুগ যুগ ধরে আমাদের মস্তিষ্ক কোষে বাসা বেঁধে থাকা 'ধর্ম' নামক এক আফিমের নেশা, সামাজিক পরিবেশ, ভয়, লজ্জা ... ইত্যাদি ইত্যাদি।

যে সবকিছু প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে নিজের আদর্শ ও মূল্যবোধে অবিচল থেকে যুক্তিসম্মত চিন্তাধারার বাস্তবিক প্রয়োগে সফল হয়ে ওঠে একমাত্র সেই সাময়িক ভাবে সেই পরিস্থিতিতে সামাজিক পরিবেশের কাছে ঘৃণার পাত্র হয়ে উঠলেও, ইতিহাসের পাতায় সে নায়ক রূপে বিদ্যমান থাকে।

সকল প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার বাস্তবিক প্রয়োগের এক গল্প আমি বলব। বলব আমার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা। বলব 'ধর্ম' নামক এক নেশার ঘোর কাটিয়ে মরণোত্তর দেহদানের মধ্য দিয়ে এক সাধারণ মানুষের অসাধারণ কৃতিত্বের গল্প।

সাল ২০১৫, ৩০ ডিসেম্বর।

তখন প্রায় দুপুর ২ টো। আমার ঠাকুমা, লীলাবতী কর্মকার নিজ বাড়িতে বয়সজনিত কারণে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

আমাদের পরিবার আগে থেকেই যুক্তিবাদী চিন্তাধারার আদলে সংগঠিত। যে কোন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের উর্দ্ধে আমাদের পরিবারের সদস্য। আমার বাবা, সঞ্জিৎ কর্মকার-এর হাত ধরেই আমাদের পরিবারে বস্তুবাদী চিন্তাভাবনার অনুপ্রবেশ। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের সাপেক্ষে আমরা নাস্তিক হলেও, আমরা "মানবতাবাদী"।

এই রকম একটি পারিবারিক পটভূমিকায় ঠাকুমার মৃত্যুর পর কোন ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান করা ছিল আদর্শ, মূল্যবোধ থেকে সরে আসা, যা ছিল আমাদের পক্ষে লজ্জাজনক। আদর্শ ও নীতিবোধের কথা মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল ঠাকুমার মৃত্যুর পর তাঁর মৃতদেহ মেডিকেল কলেজে দান (Donate) করা হবে। এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল মৃত্যুর অনেক আগে থেকেই এবং ঠাকুমার ইচ্ছাতেই।


তবে সেদিন (৩০ ডিসেম্বর) আমাদের চিন্তাভাবনার বাস্তবিক প্রয়োগের পরীক্ষায় সফল হওয়া খুব একটা সহজ ছিল না।

যেহেতু ঠাকুমা বাড়িতে মারা গেছেন সেহেতু স্থানীয় হাসপাতাল থেকে থেকে ডেথ সার্টিফিকেট প্রদান করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে। আবার অন্যদিকে মৃত্যু প্রমাণপত্র না পেলে মেডিকেল কলেজও বডি গ্রহণ করবে না। এই অবস্থায় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় স্থানীয় হাসপাতালের বি.এম.ও.এইচ., ড. দেবেশ নাথ। তাঁর পরামর্শে আমরা কালীগঞ্জ গ্রাম পঞ্চায়েতের কাছে মৃত্যু শংসাপত্র প্রদানের দাবি জানাই। প্রধানের অনুপস্থিতিতে আমাদের উপপ্রধানের কাছে দ্বারস্থ হতে হয়। তিনি বলেন মৃতদেহ আগে দাহ করা হবে, তারপর মৃত্যু প্রমাণপত্র দেওয়া হবে, তার আগে নয়। শুরুতেই একটি ধাক্কা, তার উপর আমাদের পরিবার তথা আমাদের এলাকা থেকে প্রথম এমন একটি সমাজকল্যাণ মূলক কাজের জন্য একটি মাত্র কাগজের জোগাড় করার উপায় না পাওয়ায় পরিবারের মুখে এক অসহায়তার ছাপ ফুটে ওঠে। এমতাবস্থায়, যোগাযোগ করা হয় যুক্তিবাদী আন্দোলনের পথিকৃৎ, প্রবীর ঘোষ মহাশয়ের সঙ্গে। প্রবীর দা বাবাকে বলেন, "তোমাকে ডেথ সার্টিফিকেট যে কোন প্রকারে জোগাড় করতেই হবে। সহজ রাস্তায় যখন পাওয়া যাচ্ছে না, তখন লড়াই করো। লড়াই করে আদায় করতে হবে। " প্রবীর দা-র কথায় সাহস জুগিয়েছিল বাবাকে। এরপর বি. এম. ও. এইচ. ড. দেবেশ নাথ মারফৎ বি. ডি. ও. কে সব কিছু জানানো হয়। বি. ডি. ও.-র সহযোগিতায় তখন গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান মৃত্যু প্রমাণপত্র দিতে বাধ্য হয়।


তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে। ইতিমধ্যে গোবড়াপোতা থেকে "শুভেন্দু মেমোরিয়াল সেবা প্রতিষ্ঠান" নামক একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা উপস্থিত হয়, যেখানে ঠাকুমার চক্ষুদান করা হয়। অবশেষে মৃত্যু প্রমাণপত্র হাতে আসার পর শবদেহ নিয়ে রওনা হয়, কল্যাণীর "কলেজ অফ মেডিসিন এন্ড জে. এন. এম. হসপিটল" এর উদ্দেশ্যে। মেডিকেল কলেজে যখন মৃতদেহ নিয়ে হাজির, তখন সকাল। কোন সিনিয়র ডক্টর, প্রফেসর ছিলেন না। দেখা হয়েছিল এক জুনিয়র ডাক্তারের সাথে। তিনি মৃতদেহ পুরোপুরি ভাবে গ্রহণের কথা দিতে না পেরে বডি মেডিকেল কলেজে রেখেই, তিন দিন পর, ৪ ঠা জানুয়ারি, ২০১৬ তে আবার মেডিকেল কলেজে আসার কথা বলেন। যথারীতি যাওয়া হয় আবার। এবার সিনিয়র ডাক্তারকে দেখানো হয় মৃত্যু প্রমাণপত্র। গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে অনুমোদিত মৃত্যু প্রমাণপত্র সন্তুষ্ট করতে পারেনি ডাক্তারকে। সিনিয়র ডক্টর জানালেন কোন রেজিস্ট্রিকৃত ডাক্তার কর্তৃক অনুমোদিত মৃত্যু প্রমাণপত্রই গ্রহণযোগ্য হবে এবং তখন বডি গ্রহণ করা হবে। কোন উপায় না দেখে, আমাদের গ্রামের এক প্র্যাকটিসিং হোমিওপ্যাথি ডাক্তার, সুকদেব দত্ত- এর অনুমোদিত মৃত্যু প্রমাণপত্র নিয়ে আবার হাজির হতে হয় মেডিকেল কলেজে। এরপরও সেই সিনিয়র ডাক্তার হোমিওপ্যাথি-র অজুহাত দেখিয়ে মৃতদেহ গ্রহণ করতে নাকচ করে এবং মৃতদেহ ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। সেই সময় তীরে এসে তরী ডোবার মতো অবস্থা। এই অবস্থায় ওই সিনিয়র ডাক্তারের সাথে আমাদের বি. এম. ও. এইচ. এর ফোনে কথা বলানো হয়। শেষপর্যন্ত ঠাকুমার মৃতদেহ "কলেজ অফ মেডিসিন এন্ড জে. এন. এম. হসপিটল" স্বসম্মানে পুরোপুরি ভাবে গ্রহণ করে।

শুভেন্দু মেমোরিয়াল সেবা প্রতিষ্ঠান মারফৎ কর্ণিয়া প্রদান করা হয় "প্রভা আই ব্যাঙ্ক" এ। সেদিন এক নৈতিক যুদ্ধ জয়লাভের স্বাদ গ্রহণ করেছিল আমাদের পরিবার। জয়ী হয়েছিল আমাদের আদর্শ। এক সাধারণ পরিবার, অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিল সেদিন গ্রামবাসী তথা এই সমাজের কাছে। তাছাড়া আমাদের পরিবার কোন প্রকার ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান, শ্রাদ্ধ- শান্তি অনুষ্ঠানকে পুরোপুরি ভাবে বর্জন করেছিল। একজন যখন সমাজের অন্যদের থেকে পৃথক কল্যাণমূলক কাজ করে তখন তাকে নিয়ে অনেক আলোচনা, সমালোচনা হবেই জনমানসে। ঠাকুমার মরণোত্তর দেহদানের পর গ্রামবাসী দের মধ্যে এক বিস্তর সময় ধরে আলোচনা, সমালোচনা চলেছিল। অনেক মানুষের কাছে এক অভাবনীয় সাফল্য মনে হয়েছে, আবার কিছু মানুষের কাছে ধর্মের আচার নস্যাৎ হওয়ায় ভয়ে কুৎসাও রটিয়েছিল। যদিও কুৎসা রটানো লোকেদের বক্তব্য সেভাবে কারোর কাছে গুরুত্ব লাভ করেনি।

সাল ২০১৯, ২০ জুলাই।

আমার বড়ো জেঠু (বাবার বড়দা) , সনাতন কর্মকার প্রাণত্যাগ করেন। জেঠুর আগে থেকেই শারীরিক কিছু সমস্যা ছিল। রাত তখন ১০ টা হবে। জেঠুর শারীরিক অবস্থা শোচনীয় দেখে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এবং সেখানেই মৃত্যু বরণ করেন।

ঠাকুমার মতোই জেঠুর ও দেহদান করা হয়। জেঠুর সদিচ্ছাতেই করা হয়েছিল। তবে এক্ষেত্রে ঠাকুমার মতো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়নি। হাসপাতালেই মারা যাওয়ার ফলে হাসপাতাল থেকেই মৃত্যু প্রমাণপত্র পাওয়া যায়। কিন্তু এক্ষেত্রে আমরা চক্ষুদান করতে পারিনি। অনেক চেষ্টা করেও ওইসময় যোগাযোগ করা যায়নি চক্ষুদানের জন্য। পরদিন জেঠুর মৃতদেহ দান করা হয় "মুর্শিদাবাদ মেডিকেল কলেজে"।


আমাদের পরিবার থেকে পরপর দুটি সফল মরণোত্তর দেহদানে অনুপ্রাণিত হয়ে আমার এক খুড়তুতো ঠাকুমারও চক্ষুদান করা হয়। ২০১৯ সালে ২৪ ডিসেম্বর আমার খুড়তুতো ঠাকুমা, দীপালি কর্মকার নিজ বাড়িতেই প্রাণত্যাগ করেন। এক্ষেত্রে পূর্বে দেহদানের ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় শুধু চক্ষুদান করা হয়। এই কাজে সর্বাগ্রে এগিয়ে এসেছিলেন তাঁর পুত্রবধু মঞ্জু কর্মকার।

এই ঘটনাটি আমাদের পারিবারিক নয়। আমাদের এক সহযোদ্ধা, বাবার বন্ধু, শিবুরাম মন্ডল-এর লড়াই। তিনিও চেয়েছিলেন ধর্মের বাঁধন থেকে মুক্ত হয়ে নিজের বাবা-মায়ের মরণোত্তর দেহদানে অঙ্গীকারবদ্ধ হতে।

সাল ২০২০, ১০ অক্টোবর ।

রাত্রে নিজ বাড়িতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন শিবুরাম মন্ডল-এর মা, বীণা মন্ডল। গ্রামের এক ডাক্তার, সুদেব দাক্ষীৎ এর থেকে ডেথ সার্টিফিকেটও পাওয়া যায়।

তবে COVID–19 এর মহামারীর প্রকোপে কোন মেডিকেল কলেজই শবদেহ গ্রহণ করেনি। চক্ষুদানও করা যায়নি।

এই পরিস্থিতিতে শবদেহ নিয়ে যাওয়া হয় বহরমপুরে, গোরাবাজার শশ্মানে। ইলেকট্রিক চুল্লিতে দাহ করা হয়। যেহেতু আমরা আত্মার অস্তিত্বকেই পুরোপুরি ভাবে নস্যাৎ করেছি, তাই সেক্ষেত্রে আত্মার শান্তির জন্য শ্রাদ্ধ শান্তি করাটাও বোকামির পরিচয়। সেকারণে মৃত্যু পরবর্তী যাবতীয় ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানকে পুরোপুরিভাবে বর্জন করেছেন শিবুরাম মন্ডল। যদিও নিজে আত্মার অস্তিত্বে অবিশ্বাসী হয়ে শ্রাদ্ধ শান্তি থেকে বিরত থাকলেও নিজের ভাই বা দিদির ধর্মীয় কাজকর্মে কোন প্রকার বাধা দেননি। নিজের আদর্শ ও নীতিবোধের প্রতি অবিচল থেকেছেন শিবুরাম মন্ডল।

তবে গ্রামবাসীদের দাবি ছিল – শিবুরাম মন্ডল কেও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করতে হবে। বিভিন্ন ভাবে চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টাও করা হয় শিবুরাম মন্ডল এর উপর। কিন্তু শিবুরাম মন্ডলের পাশে ছিল তার বাবা, নিত্যানন্দ মন্ডল। নিত্যানন্দ মন্ডল বলেন — "আমার ছেলে যেটা ভালো মনে করেছে সেটাই করেছে। পিতা-মাতার কর্তব্যের প্রতি তার কোন ত্রুটি আমি দেখিনি। সে তার আদর্শ থেকে সরে আসবে না। তার উপর জোর করে কিছু চাপিয়ে দেওয়াটা অন্যায়। "

আমাদের সফলভাবে মরণোত্তর দেহদানে অঙ্গীকার বদ্ধ হওয়া, অনেক মানুষকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। ভয়, লজ্জা কাটিয়ে তারাও এই পথে এগিয়ে আসছে। বুঝতে শিখছে, দাহ বা কবর দেওয়ার থেকে মরণোত্তর দেহদান সমাজ কল্যাণের অগ্রগতির দিশারী।

0 comments

Recent Posts

See All

Comments


bottom of page