সৌরভ দেবনাথ
রাত ৯টা বেজে গেছে। ধানক্ষেতের মাঝখান থেকে একটা ঢালাই রাস্তা দুটো গ্রামের মাঝে যোগাযোগ স্থাপন করেছে৷ সেই রাস্তা ধরে শঙ্খ আর কুশল ফিরছে তাদের বন্ধু পুষ্পকদের বাড়ি থেকে৷ গ্রাম বললেও এই গ্রামের প্রায় সব লোকের কাছেই স্মার্টফোন আছে৷ নেই শুধু বিজ্ঞানমনস্কতা৷ কুশল তার ফোনে টাইপ করে চলেছে কিছু একটা৷ সেই কিবোর্ডের টকাটক শব্দ শুনতে পাচ্ছে শঙ্খ৷ পুষ্পকদের বাড়িতে আজ বেজায় তর্ক হয়েছে পুষ্পকের সাথে৷ পুষ্পকের কোন দাদু নাকি জ্যোতিষি৷ ভদ্রলোক নাকি পুষ্পককে বুঝিয়েছেন যে ধর্ম আর বিজ্ঞানের কোনো তফাৎ নেই৷ প্রাচীন ঋষিরা অনেক কিছু জানতো বিজ্ঞানের ব্যাপারে৷ বিবেকানন্দ নিজেও সে কথা বলেছেন এমন যুক্তি টেনে বিজয়ী ভেবে নিল নিজেকে পুষ্পক৷ কুশল যথারীতি নিউট্রাল৷ সে মজা নিয়ে গেছে৷
আকাশের দিকে তাকিয়ে শঙ্খ দাঁড়িয়ে পড়ল৷ আজ অনেকগুলো তারা দেখা যাচ্ছে৷ বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল সে। কুশল এগিয়ে গেছিল মোবাইলে টাইপ করতে করতে৷ পেছন ফিরে দেখল শঙ্খ আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে৷ কুশল শঙ্খের কাছে গিয়ে বলল "বাড়ি চল অনেক রাত হলো।" কুশল সে কথায় কান না দিয়ে "বললো আজকের দিনটা কি জানিস?"
-“১৭ ই ফেব্রুয়ারি।’’
-"হ্যাঁ। কিন্তু আজকের দিনটার বৈশিষ্ট্য কি?”
-“জানিনা ভাই।”
-"আজ হলো এমন একজন মানুষের মৃত্যুদিন যাকে বিজ্ঞানের ইতিহাসে প্রথম শহীদ বলা হয়। আজ জিয়র্দানো ব্রুনোকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল।"
-“এই জিয়র্দানো ব্রুনো কে?”
-“আমরা সবাই গ্যালিলিওর কথা জানি, কোপারনিকাসের কথা জানি৷ কিন্তু ব্রুনোর কথা আমরা শুনিনা৷ আজ যখন পুষ্পক তার দাদুর বলা বুলি আওড়ে বলল বিজ্ঞান আর 'ধর্ম একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ' তখনই বিজ্ঞানের জন্য যাঁরা প্রাণ দিলেন তাঁদের আত্মবলিদান নস্যাৎ করে দিল সে৷
-“আচ্ছা শঙ্খ একটা কথা তো মানবি যে স্পিরিচুয়ালিটি বলে কিছু হয়?”
-“আচ্ছা কুশল, তুই আমাকে স্পিরিচুয়লিটির সংজ্ঞাটা বল তো? ইউটিউবে যে বাবাজিরা সং সেজে স্পিরিচুয়লিটির কথা বলে সেটা? যারা অপবৈজ্ঞানিক কথা বলে তারা? যারা ব্যাকগ্রাউন্ডে ওম সাউন্ড চালিয়ে জ্যোতিষচর্চা করে তাদের স্পিরিচুয়ালিটি?”
-“তুই বলছিস বটে কিন্তু তাঁরা যদি ঠিক নাই হবে তাহলে তাঁদের এত ভক্ত কেনো হবে?”
-“শোন তবে একটা কথা বলি। প্রথমত আমার কাছে স্পিরিচুয়ালিটি হলো রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে আমার যে অনুভূতি। যত দূরে তারা আমি দেখি তারা তত পুরনো। কার্ল সাগান যে বলে গেছেন 'উই আর স্টার স্টাফ' তার মানে আমার শরীরের প্রতিটা উপাদান তারাদের থেকে জন্ম নিয়েছে। আমার শরীরের প্রতিটা হাইড্রোজেন আর হিলিয়াম পরমাণুর বয়স মহাবিশ্বের বয়সের সমান। আমি রাতের আকাশের দিকে তাকালে এমন অনেক তারা দেখতে পাচ্ছি যেগুলোর অস্তিত্ব নেই। কিন্তু তাদের আমরা দেখতে পাচ্ছি। এই যে অনুভূতিগুলো এটাই আমার কাছে স্পিরিচুয়ালিটি।
আর তুই যে বলছিস যে সেইসব স্পিরিচুয়াল বাবাজিদের এত ভক্ত কেনো, আমাকে বল তো যদি গণবিশ্বাস বিজ্ঞান হতো তাহলে গ্যালিলিও, কোপারনিকাস এনারাও তো ভুল। আজও মহাবিশ্ব পৃথিবীকেন্দ্রিক হতো। তা তো নয়?"
-“হুম। ঠিকই বলেছিস তুই। আচ্ছা এই জিয়র্দানো ব্রুনোর ব্যাপারে তুই যা জানিস একটু বল তো”
-“ইউরোপের চার্চের কিরকম নিপীড়ন ছিল সে তো কিছু কিছু জানিস। ধর্ম, শিক্ষা, রাজনীতি সবই একসাথে ছিল। চার্চের বিরুদ্ধে কথা বলা মানেই মৃত্যুদণ্ড। ষোলো শ শতকে কোপারনিকাস তাঁর বইতে লিখলেন মহাবিশ্ব সৌরকেন্দ্রিক। কিন্তু ধর্মের ষাঁড়গুলো কেনো মেনে নেবে? তাদের ধর্মের ওপর নাকি অপমান হয়েছে। কিন্তু একজন পাদ্রী ছিল যে কোপারনিকাসের সৌরকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের সমর্থন শুধু নয় তা প্রচারও করতো। এমনকি একধাপ এগিয়ে বলতে শুরু করলো মহাবিশ্ব অসীম। দূরের যে তারাগুলো তারাও এক একটা সূর্য। তাদের চারপাশে আমাদের পৃথিবীর মত গ্রহ ঘুরছে। আমাদের সূর্য সেই তারাদের মতোই একটা তারা। তখনকার দিনের চার্চের নিষিদ্ধ বিজ্ঞানের বইও সে লুকিয়ে পড়ত।”
-“এখানে একটা কথা বলতে চাই যে তার কাছে তো কোনো প্রমাণ ছিলনা?”
-"না। কারণ টেলিস্কোপ তখনও আসেনি। অ্যাস্ট্রোনমাররা খালি চোখেই দেখতো ধৈর্য্য ধরে। ব্রুনোর সব কথা হয়তো ঠিক নয়। সে তার সময়ের ফসল। কিন্তু তার কৃতিত্ব এখানেই সে বৈপ্লবিক একটা ভাবনা ভেবেছিল। চার্চের ধরাবাঁধা গণ্ডির বাইরে বেরোতে চেয়েছিল। চার্চের সেটা সহ্য হবার কথা নয়। হয়ওনি। ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডে নিজের বক্তব্য রাখার সুযোগ পেল। সেখানে গিয়ে নিজের ভাবনার সব উজাড় করে দিতে চাইল। কোপারনিকাসের সমর্থনে বলতে চাইল। কিন্তু সেখানেও তাঁকে অপমানিত হতে হলো। সবাই বলতে লাগলো সে হেরেটিক বা অধার্মিক। আট বছর তাঁকে বন্দী করে রাখা হয়। অকথ্য অত্যাচার করা হতো তাঁকে। বলা হতো যাতে মেনে নেয় সে যা বলেছে সব ভুল। কিন্তু সে ছিল ব্রুনো। নিজের সিদ্ধান্তে অনড় অটল। ইনকুইজিশন নামক প্রহসন চললো। সেখানেও কার্ডিনাল তাকে ক্ষমা চাইতে বলল। কিন্তু ব্রুনো তার ভাবনা থেকে এক চুলও সরে দাঁড়াতে নারাজ। অবশেষে ষোল-শ খ্রিস্টাব্দে আজকের দিনেই রোমের ক্যাম্প্যে ডি ফিওরি স্কোয়ারে প্রকাশ্যে পুড়িয়ে মারা হয় ব্রুনোকে। রোমের জনগন সেদিন পুড়ে যেতে দেখেছিল এক অবিশ্বাসীকে। সবাই ভেবেছিল তাদের ধর্ম বুঝি রক্ষা পেল। কিন্তু তারপর আমরা সবাই জানি সত্যিটা কি। সবথেকে বড় কথা কি জানিস তো আমরা এতকিছু জানার পরেও বলব বিজ্ঞান আর ধর্মের কোনো বিরোধ নেই। সত্যিই কি তাই? এখনকার দিন গুলোতে দেখ তো একবার বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান এনাদের পরিণতি। আমাদের দেশেই নরেন্দ্র দাভলকার যিনি চেয়েছিলেন কুসংস্কার বিরোধী আইন আনতে তাঁকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হলো। এদেশে এখনও ডাইনি সন্দেহে পিটিয়ে মানুষ খুন হয়। এত কিছুর পরেও যদি বলো বিজ্ঞান আর ধর্ম একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ তাহলে এই মানুষগুলোর অপমান।"
এরকম একটা ঘটনা শুনে কুশলের মনটা খারাপ হয়ে গেলো। সে বলল "আচ্ছা আমাদের তবে কি করণীয়?”
-"আমরা যদি বিজ্ঞানমনস্ক হতে পারি, সবসময় যদি বিজ্ঞানের প্রচার করি, কুসস্কারের বিরুদ্ধে লড়তে পারি তাহলেই তাঁদের বলিদান বিফলে যাবেনা। তুই, পুষ্পক তোরা যেদিন তোদের হাতের জ্যোতিষ রেকমেন্ডেড আংটিগুলো খুলে ফেলতে পারবি, যেদিন মনের সব ভয় দূর করে জাত, ধর্ম, বর্ণ ভুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে মন থেকে বলতে পারবি 'উই আর স্টার স্টাফ' সেইদিন হয়তো সেই মানুষগুলো যথাযথ সম্মান পাবেন।"
দুজনেই এরপর আবার হাঁটা শুরু করলো। শঙ্খ লক্ষ্য করলো কুশল আংটিগুলো খুলে নিজের পকেটে রাখলো। শঙ্খের দিকে তাকিয়ে বললো “চেষ্টা করবো এগুলো যাতে আর না পরতে হয়”
শঙ্খ শুনতে পেল কুশল মাঝে মাঝেই বিড়বিড় করে বলছে “উই আর স্টার স্টাফ।”
Comments