top of page
Writer's picturePrasenjit Konar

শেষ ইচ্ছা


-জামাল আনসারী

পৃথিবীতে মানুষের জনসংখ্যা প্রতিদিনই ভরা বর্ষায় উত্তাল গঙ্গা নদীর জলপ্লাবনের মতো বাড়লেও সেই মানুষ গুলির মধ্যে দৈহিক মিল যেমন নেই, তেমনি তাদের আচার -ব্যবহার, রীতি নীতি, খাদ্যাভ্যাস, এমনকি সবার ইচ্ছা ,আকাঙ্ক্ষাও তারতম্য আমাদের চোখে খুবই প্রকট রূপে ধরা পড়ে।আপাত দৃষ্টিতে, খালি চোখে, প্রতিটি মানুষেই দেখতে অন্য মানুষেরই প্রতিচ্ছবি মনে হতেই পারে।কিন্তু মনে হলেও আমরা কার মনে কি আছে? তা কি জানতে পারি? বলতে গেলে আমরা কেউই নিজের মনে কি আছে, বা আমি কি ভাবছি ...শতচেষ্টা করেও তারই কুলকিনারা খুঁজে উঠতে পারি নি ,তারপর আবার অপরের মনের কথা বোঝা! খুব ভালো ভবিষ্যৎ বক্তাও বোধ হয় বলতে পারবে না।

গাছ থেকে পাকা ফল পড়লেই কি সেই পাকা ফল থেকে তখনই নতুন চারা গাছের জন্ম হয়? তা হয়তো সাথে সাথেই হয় না। তবে এ কথা সত্য, সেই ফলের ভিতরে সুপ্ত অবস্থায় আগামীদিনের নতুন গাছ ঘুমিয়ে থাকে। আলো,বাতাস,উত্তাপের সংস্পর্শে উপযুক্ত আবহাওয়ায় অঙ্কুরোদগম এর মাধ্যমে তা বিকশিত হয়।

নতুনডি গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মহিদুল ইসলামেরও একটি ইচ্ছা দীর্থ আটাশ বছর চাকুরী কালব্যাপি সুপ্তই ছিল। এতদিনের সুপ্ত ইচ্ছাটা যে কি! তা তার একমাত্র সহ ধার্মিণী সালমা বিবি কেন,কাক পক্ষীও কোনদিনই জানতো না।

সেদিন মঙ্গলবার। অকালে মা মরা সাবিনাকে হাতে ধরে হাঁটতে হাঁটতে সালমা বিবি গ্রামের শেষ প্রান্তে গজিয়ে ওঠা বিশাল প্রাসাদসম ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে পৌঁছে দিতে চলে গেল।যদিও বাড়ি থেকে স্কুলের দুরত্ব খুব একটা বেশি নয়।পাঁচশো মিটারের মতো হবে। সাবিনা একা একা যেতেও পারবে। কিন্তু কেউ ঠিক করে জানে না, যে কি গূঢ় রহস্যময় কারনে সবারই বাড়ির অবিভাবকরা তাদের ছেলে মেয়েদের স্কুলে পৌঁছে দেয়। তাই সাবিনাকেও তারা পৌঁছে দেয়। মহিদুল হিসেব করে দেখে,তার স্ত্রীর স্কুল থেকে ফিরে আসতে মিনিট কুড়ি লাগবেই। বাড়িতে আর কেউ নেই।বিছানার তলা থেকে এলাহাবাদ ব্যাঙ্কের পাস বইটা আস্তে আস্তে টেনে বের করে মহিদুল। তারপর একটু ইতস্তত করে, জানলার দিকে একটু উঁকি মেরে, কেউ ধারে পাশে নেই, এটা নিশ্চিত হলেও সদর দরজাটা ভেজিয়ে দেয়।কিন্তু দরজায় খিল দেয় না।দড়ি বাধা মোটা কাঁচের চশমাটা চোখে দিয়েই, ব্যাঙ্কের পাসবইটা হাতে নিয়ে ভালো করে উল্টে পাল্টে দেখে।

মনের আনন্দে অস্ফুট স্বরে বলে উঠে, আর মাত্র কুড়ি হাজার টাকা! তারপরই সে হজ যাত্রা করতে পারবে। তাঁর আর কোনো চিন্তা নেই! বলেই আবার যথাস্থানে ব্যাঙ্কের পাসবইটা রেখে দেয়। দরজার দিকে ফিরে তাকাতেই দেখে তার সহ ধার্মিণী চৌকাঠ ধরে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। আদালতে আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করে , বিচারক যখন ফাঁসির আদেশ পড়ে শোনায় তখন আসামির মুখটা যে রকম পাংশু বর্ণের দেখতে হয় , মহিদুলের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তার কি করণীয় তা ক্ষনিকের জন্য হলেও বিস্মৃত হয়।

সালমা বিবি স্বামীকে উদ্দেশ্য করে কৌতূহল দৃষ্টিতে বলে, হ্যাঁ গো তুমি কি সত্যিই মক্কায় হজ করতে যাবে?

...হুম।যাবো। বিহ্বলভাব কাটিয়ে দৃঢ়তার সাথে বলে মহিদুল।

কিছু কিছু তীর্থস্থান এই ধরাধামে আছে। ধার্মিকদের দৃঢ় বিশ্বাস, সেখানে একবার পৌঁছাতে পারলে তার স্বর্গের প্রবেশদ্বার কেউ রুদ্ধ করতে পারবে না। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক মহিদুল ইসলামও অন্য আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতোই সেই বিশ্বাসকে দীর্ঘ আটাশ বছর ধরে অন্তরের অন্তিম স্থানে লুকিয়ে রেখেছে। তাই সুদীর্ঘ চাকুরিকাল ব্যাপী সংসারের সমস্ত দায় দায়িত্ব পালন করেও তিল তিল পরিমান টাকা বাঁচিয়ে রেখেছে। সেই টাকা আজ ব্যাঙ্কে জমা হতে হতে দুই লাখ আশি হাজার হয়েছে।

সালমা বিবি আর চৌকাঠ না ধরে রেখে স্বামীর কাছে আস্তে আস্তে আসে। সু সজ্জিত পালঙ্কের উপর বসতে বসতে একটু হেঁয়ালী করে বলে, সে তো অনেক টাকার ব্যাপার! আমাদের মতো আদর ব্যাপারী হয়ে জাহাজের খবরে কাজ কি?

.... স্ত্রীর প্রশ্নটির উত্তর এড়িয়ে মহিদুল আদরের স্বরে বলে,জানো সালমা। যতদিন চাকুরী করেছি। ততদিন শুধু আমাদের দুই মেয়ের লেখাপড়া, তারপর ভালো ঘর, ভালো বর, দেখে বিয়ে দেওয়া। আপামর বাঙালির মতো আমিও সেই স্বপ্নই দেখেছি। সে কাজ আমি সাফল্যের সাথে সমাধান করেছি.....

গর্বভরে প্রসন্ন চিত্তে সালমা বিবি জানায়, সে কথা জানি। আমাদের বড় মেয়ে নার্স হয়েছে। আর ছোট মেয়ের জামাই তো তোমার মতোই স্কুলের ....

মহিদুল তার স্ত্রীকে মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে শুষ্ক মুখে একটু হেসে বলে, সে নিয়ে আজ আর আমার কোনো দুঃখ, বা কষ্ট নেই। তবে...

....তবে কি? স্বামীর চোখের দিকে এক পলক তাকিয়ে মুখটা নিচু করে তাড়াতাড়ি বলে সালমা বিবি।

মহিদুল তার স্ত্রীর হাতটা টেনে, নিজের উরুর উপরে ধরে হাতটি রাখে।সালমা বিবির নিচু করে রাখা মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, আমার এতদিন সব ইচ্ছেই আল্লাহ পূর্ন করেছে। শেষ ইচ্ছা একবার মক্কায় হজ করতে যাওয়া। বেশ এই টুকুই আমার শেষ ইচ্ছা।এটা আমার অনেকদিনের স্বপ্নও বলতে পারো! কখনোই আমি তা প্রকাশ করি নি। আজ শুধু তোমাকেই বলছি।

..মুখটা তুলে স্বামীর মুখের দিকে তাকায় সালমা বিবি।তারপর দুই হাত তুলে আল্লাহর কাছে দোয়া মাগে, হে আল্লাহ!তুমি আমার স্বামীর শেষ ইচ্ছাটা পূরণ করো।বলেই স্বামীর পালঙ্ক থেকে উঠে যায়।


(2)

সাবিনার বয়স যখন মাত্র পাঁচ বছর, তখন তার মা ইহলোকের সমস্ত মায়া মমতার বন্ধন ছিন্ন করে, সাবিনাকে মায়ের স্নেহ, ভালোবাসা থেকে চিরদিনের জন্য বঞ্চিত করে, সেই অসীমলোকে ,না ফেরার দেশে চলে যায়। অবশ্য তার মায়ের আজ দোষ দেওয়া বৃথা। মমতাময়ীর কোন যথার্থ দোষ ছিলও না।সাবিনার পাষণ্ড, হৃদয়হীন,মদ-মাতাল বাবার অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে, একদিন তার মা আত্মহত্যা করেই ,পার্থিব জগতের সমস্ত অন্যায় অত্যাচার থেকে মুক্তি লাভ পায়।কিন্তু তার সাবিনা? .....

সাবিনার বাবা কতটা হৃদয়হীন, সেটা আরো স্পষ্ট করে প্রতিবেশীরা বুঝতে পারে, যখন তার মরা বউয়ের চল্লিশা, মানে 40 দিন পার না হতেই শহরের এক সুন্দরী মেয়েকে বউ করে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসে। প্রতিবেশীরা কেউ কেউ আবার বলে, সারা পৃথিবীতে খোঁজ করলেও নাকি এই রকম পাষণ্ড বাপ খুঁজে পাওয়া মুশকিল! কেউ কেউ আবার ফিসফিসিয়ে বলে, শহরের এই সুন্দরী মেয়েটার জন্যই নাকি সাবিনার মা মরতে বাধ্য হয়েছে।

সে যে যাই বলুক না কেন। সাবিনা তাদের কথায় কোন কান দেয় না। সে নতুন মা পেয়ে সেদিন খুশিই হয়েছিল। সে প্রথমে ভেবেছিল তার নিজের মা না থাকলেও নতুন মা তাকে মাতৃস্নেহে আদর যত্ন করে, মায়ের মতই ভালো বাসবে।

কিন্তু তার সেই আশা আর পূর্ণ হল না। কিছুদিন যেতে না যেতেই সে বুঝতে পারে, এই বাড়িতে তার আর কোন অধিকার নেই, আবদার করার জোও নেই।এখন কথায় কথায়, উঠতে বসতে সৎ মা তাকে মারধর করে।

সে বাবাকে নালিশ করলে মারধরের মাত্রাটা আরো বৃদ্ধি পায়।তাই সে চুপ করে,মুখ বুজে সব অত্যাচার সহ্য করে যায়।কিন্তু তাঁর জীবনটা এই কিছুদিনই দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।যেদিন সাবিনা প্রথম উপলব্ধি করে যে, তাকে তাঁর জান্নাতবাসী মায়ের রাস্তায় অবলম্বন করতে হবে।তা ছাড়া আর কোনো রাস্তাই এখন খোলা নেই।সেদিনই তাঁর মামা মহিদুল ইসলাম প্রতিবেশীদের কাছে সবকিছু জেনে শুনে সাবিনাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যায়।


তারপর আজ পর্যন্ত সাবিনা আর নিজের বাবার বাড়ি দিকে ফিরেও তাকায় না।মহিদুল তার ভাগ্নিকে নিজের মেয়ের মতই ভালোবাসে। নতুনডি গ্রামের একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে সে ক্লাস ফোরে এখন পড়াশোনা করে।


(3)

বাঙালিরা মাছ খেতে খুব ভালোবাসে কিন্তু খেতে খেতে যদি মাছের কাঁটা গলায় বিদ্ধ হয়। কেমন লাগে? সে অনুভূতি বোধ হয় যার গলায় মাছের কাঁটা লেগেছে, সে ছাড়া আর অন্য কেউ জানে না। যতক্ষণ না সেই কাঁটা গলা বেয়ে উদরে প্রবেশ করছে ততক্ষণ সেই মাছের কাঁটার কথায় সে মনে মনে চিন্তা করে যায়।মহিদুলেরও যতদিন না হজযাত্রা সফল হচ্ছে, একটাই চিন্তা তাঁর মাথার মধ্যে নদীর জলতরঙ্গের মত এসে ধাক্কা মারছে।কিছুতেই সে ঐ চিন্তা ছাড়া অন্যকিছু ভাবতে পারছে না।


মহিদুল পড়ার টেবিলে ঝুঁকে ফাইবারের চেয়ারে বসে পাসপোর্ট এর জন্য ফরম পূরণ করছে।কিছুটা পূরণ করে রান্না ঘরের দিকে তাকিয়ে ডাক দেয়...সাবিনা!

সাবিনা ঘরের মেঝেতে মাদুর পেতে বসে ড্রইং এর খাতার উপর রঙ পেনসিল দিয়ে একটা মক্কার ছবি অঙ্কন করছে। মামার গলার স্বর কানে যেতেই পেন্সিলটা নামিয়ে জোর গলায় বলে,

মামা।আমায় ডাকছো?

হুম।এক গ্লাস খাবার জল আনো তো মা।

সাবিনা যেদিন থেকে মামার বাড়ি এসেছে,সেদিন থেকেই এই বাড়ির ছোটখাটো কাজ গুলো মনের আনন্দে সে নিজেই করে।মামা বা মামী কেউ তাকে কাজ করতে বাধ্য করেনি।তাঁর কাজ করতে ভালো লাগে, তাই সে করে। সাবিনা ফ্রিজ খুলে বোতলে রাখা ঠান্ডা জল একটি কাঁচের গ্লাসে ভরে। ফ্রিজটি লাগিয়ে ঠান্ডা জলের গ্লাসটা মামার হাতে তুলে দিয়ে চুপচাপ অদূরে দাঁড়িয়ে থাকে।

মহিদুল এক নিঃশ্বাসে গ্লাসের সবটুকু পানীয় নিঃশেষ করে, খালি গ্লাসটা সাবিনার দিকে বাড়িয়ে বলে,..

যা একটু জল দিয়ে ধুয়ে, রেখে দে।

মহিদুল এই ছোট্ট ভাগ্নিটিকে নিজের মেয়েদের থেকে একটু বেশিই ভালোবাসে।হয়তো বা মেয়েটির কোন মা নেই তাই।তাছাড়া এটাও হতে পারে, সাবিনার বাবা থাকলেও সে বাবা থাকা না থাকা দুই-ই সমান বলে।।সাবিনার বয়স কম হলে কি হবে ! সে কাজে যেমন লেখাপড়াও তেমনি সমান পারদর্শী।কোন কাজ একবার তার মামিকে করতে দেখলেই সে নিজেও সে কাজটা অনায়াসে করতে পারে।পাসপোর্ট এর ফর্ম টা পুরোটা ফিলাপ করে ফর্মের একেবারে নিচে স্বাক্ষর করতে করতে মহিদুল আবার ডাক দেয়,...সাবিনা।

সাবিনা মক্কার ছবিতে লাস্ট ফিনিশিং এর রং করতে লেগেছে।সেটা হাতে তুলেই সে বলে ..কি মামা ?কিছু বলছো ?

-হ্যাঁ। তোর মামী আছে তো একবার ডাক দেখি।দরকার আছে।

সাবিনা খাতাটা হাতে নিয়েই রান্নাঘরে গিয়ে মামীকে ডেকে, সঙ্গে নিয়েই মামার কাছে চলে আসে।

মহিদুল হাতে ধরা কলমটা ফিলআপ করা পাসপোর্ট এর ফর্মের উপর রেখে তার স্ত্রীর দিকে চোখ তুলে বলে ,আগামীকালই আমি ফর্মটা পাসপোর্ট অফিসে জমা দিয়ে দিচ্ছি।আশা করি কয়েকদিন পরেই কাজ হয়ে যাবে।

সালমা বিবি কিছু না বলে শুধু একটু ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে দেই।

কিন্তু সাবিনা কৌতূহলের সঙ্গে বলে,ওটা কিসের ফরম মামা?

... তুই বুঝবি না মা।

...কেন বুঝবো না? বুঝিয়ে দিলেই বুঝবো মামা।সাবিনা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে।

ক্লাসে শিক্ষক যেভাবে ছাত্রকে বোঝায় সেভাবে মহিদুল সাবিনাকে বোঝায়,...

যারা নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে কোন কাজের জন্য যায় ,তাদের পাসপোর্ট ভিসা লাগে। এই পাসপোর্ট ছাড়া কিছুতেই অন্য দেশে কেউ যেতে পারে না।

..কিন্তু মামা সেটা তোমার কি কাজে লাগবে?সাবিনা হঠাৎ প্রশ্ন করে বসে।

.. দূর পাগলি! তোকে তো বলাই হয় নাই। আমার শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে কিছুদিন পরেই সৌদি আরবের দেশে মক্কায় হজ করতে যাব।তাই....

সালমা বিবি হঠাৎ স্বামীকে থামিয়ে দিয়ে বলে, একে বুঝিয়ে কাজ নেই।তুমি বরং মাথা ঠান্ডা করে কি কি করতে হবে সেগুলো করো। বলেই ঈগল পাখি যেভাবে শিকার ধরে সেভাবে চোখের পলকে সাবিনাকে নিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।কিন্তু ড্রইং এর খাতাটা ভুলবশত সাবিনা টেবিলের উপরই রেখে চলে যায়।


মুহিদুল টেবিলের ওপর ফর্মটা হাতে তুলতে গিয়েই ড্রইং এর খাতায় সাবিনার কচি হাতে সদ্য অঙ্কন করা মক্কার ছবিটার দিকে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে।ছবিটা দেখে,মহিদুল দুহাতে তুলে বুকে জড়িয়ে নেয়।পরম আনন্দে দু চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।তা মহিদুল ঠিকই টের পায়।

ইসলাম বলছে ,হজ মুসলমানদের জন্য একটি অবশ্যকরণীয় ইবাদত। এটি ইসলাম ধর্মের পঞ্চম স্তম্ভও বটে।তবে সবার জন্য হজ ফরজ নয়। আর্থিক ও শারীরিকভাবে সক্ষম হলে তবেই হজ করা ফরজ।একদৃষ্টে মক্কার ছবিটার দিকে তাকিয়ে মহিদুল বলে ,এতদিন এখানে যাব যাব করেও আর যাওয়া হয় নি। টাকার অভাব ছিল।আজ আর কোন অভাব নেই।এবার যাওয়া হবেই.... মহিদুলের চোখের সামনে মক্কার ছবিটা যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে।


(4)

সকালে ঘুম থেকে উঠে সালমা বিবি স্বামীকে মনে করিয়ে দিয়েছে আজ পাসপোর্টের ফর্মটা অফিসে জমা দেওয়ার কথা।তাই মহিদুল স্নান করে, খেয়ে দেয়ে, সকাল ন,টার মধ্যে নিজেকে প্রস্তুত করে নেয়।দরকারি জিনিসপত্র গোছাতে গোছাতে দেখে সাবিনাও তার স্কুলে যাওয়ার জন্য রেডি হয়েছে।তাই মহিদুল তাঁকে কাছে ডেকেই বলে, সাবিনা চল! আজ আমি তোকে স্কুলে পৌঁছে দিই।

..মামার কথায় সাবিনা রুক্ষ চুলের দুদিকে ফুলবাধাঁ বেণী দুলিয়ে খুশি হয়ে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়।

কাঁধে ব্যাগ নিয়ে এক হাতে সাবিনার কচি নরম হাতটি ধরে হেঁটে হেঁটে মহিদুল প্রথমেই ভাগ্নির স্কুলে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়।তারপর ভাগ্নিকে স্কুলে ছেড়ে সেখানে বাস ধরে পাসপোর্ট অফিসে যাবে।সেই মতো কিছুটা হাঁটার পর সাবিনা থমকে দাঁড়ায়। মহিদুল দেখে, রাস্তার ধারে জীর্ণ মলিন বস্ত্র পরা,ছেঁড়া আসনে বসা, একটি ভিখারিকে সাবিনা স্কুল ব্যাগ থেকে দুটি টাকা বের করে দেয়। অবশ্য সাবিনা শুধু আজ নয়, প্রতিদিনই স্কুল যাওয়ার পথে এই দুটি টাকা দান করে, মনে মনে এক অসীম সুখ অনুভব করে।ভিক্ষারীর মলিন মুখে হাসি ফুটিয়ে, মামার হাত ধরে আবার হাঁটা শুরু করে।

হাঁটতে হাঁটতে সাবিনা বলে, জানো, মামা। স্কুলের নতুন দিদিমণি একটা গান শিখিয়েছে!

... ভাগ্নির ধরে থাকা কচি হাতটা নাড়িয়ে দিয়ে মহিদুল বলে,.. কি গান রে ?একটু বল,শুনি।

.. তৎক্ষণাৎ উৎসহভরে দিদিমনির কন্ঠ নকল করে, সে হাঁটতে হাঁটতে গানটি গেয়ে চলে..

" জীবন জীবনের জন্যে,

মানুষ মানুষের জন্যে ,

একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না?

ও বন্ধু….

মানুষ মানুষের জন্যে,

জীবন জীবনের জন্যে।

একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না?"

না। সাবিনা গানটি আর শেষ করতে পারে না।একটি বাইক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সাবিনাকে সজোরে ধাক্কা মারে। সে পিচ রাস্তার উপরেই লুকিয়ে পড়ে। তার স্কুল ব্যাগটি দূরে ছিটকে গিয়ে এই দৃশ্যের নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। পরনের স্কুলড্রেস রক্তে লাল হয়ে সেই রক্ত কালো পিচের উপরে গড়িয়ে যাচ্ছে। মহিদুল কখনোই এত তাজা রক্ত দেখেনি। তাই ভয় পেয়ে যায়। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়ে।ক্ষনিকের ঘোর কাটিয়ে লোকজনের সহযোগিতায় নিকটবর্তী নার্সিংহোমে ভাগ্নিকে ভর্তি করে।চোখের জল মুছতে মুছতে ডাক্তারের কাছে, করজোড়ে অনুরোধ করে, আমার ভাগ্নি কে বাঁচান ডাক্তারবাবু।আমার ভাগ্নি কে বাঁচান.....


ওটি রুমের পাশেই মহিদুল নিথর পাথরের মূর্তির মতো একা দাঁড়িয়ে থাকে। এক মনে শুধু আল্লাহকে ডাকে।কিছুক্ষণ পরে ওটি থেকে ডাক্তার বেরিয়ে মহিদুলকে আশ্বস্ত করে বলে, পেসেন্টের মাথায় খুব জোরে আঘাত লেগেছে। এখনো জ্ঞান ফেরেনি।

... ডাক্তারবাবু ওকে বাঁচান। ডাক্তারবাবু ওকে বাঁচান। .......হাতজোড় করে বলতে থাকে মহিদুল।

..24 ঘন্টা না কাটলে কিছুই বলা যাবে না।এই বলে ডাক্তার নিজের কাজে চলে যায়।


24 ঘন্টা পর সাবিনার একটু জ্ঞান ফেরে।সে আবোল-তাবোল বকতে শুরু করে। কাউকে ঠিক চিনতেও পারে না। ডাক্তার মহিদুলকে কাছে ডেকে জানায়, পেশেন্টের মাথায় জটিল অস্ত্রোপচার করতে হবে।অনেক টাকার দরকার হতে পারে।

বাড়ির কাছাকাছি বাজ পড়লে যেমন আমাদের চোখ ক্ষণিকের জন্য হলেও তীব্র আলোকে স্তব্ধ হয়ে যায়, তেমনি ডাক্তারের কথা শুনে মহিদুল স্তব্ধ হয়ে যায়। চারদিকে ঝাপসা দেখে।অনেক টাকার দরকার। সে কোথায় এখন এত টাকা পাবে? কে তাকে এই দুর্দিনে এত টাকা দেবে ?তারপর ভাবে, তাঁর তো টাকা আছেই।

না।না।সে টাকা তো হজ করতে যাওয়ার টাকা! দীর্ঘ আটাশ বছর ধরে একটু একটু করে সঞ্চিত করে, সেই টাকা হয়েছে।সেই টাকা ডাক্তারবাবুকে দিলে তার শেষ ইচ্ছা অপূর্ণই থেকে যাবে।না।সেটা কখনোই হতে পারেনা।

সে আর ভাবতে পারে না।মাথা ঘুরতে থাকে।সাবিনার কন্ঠে গাওয়া গানটার কথা মহিদুলের বারবার মনে পড়ে,"মানুষ মানুষের জন্যে, জীবন জীবনের জন্যে.......

একদিকে তার শেষ ইচ্ছা হজ করতে যাওয়া, অন্যদিকে তাঁর একমাত্র আদরের ভাগ্নি সাবিনার জীবন বাঁচানো। কোন কাজটা তাঁর এই সময় করা উচিত? সে কিছুই ভেবে পায় না।

মা মরা মেয়ে সাবিনার মুখটা বারবার মহিদুলের চোখে ভেসে ওঠে।সে হয়তো চিৎকার করে বলছে,"মামা আমাকে বাঁচাও।আমাকে বাঁচাও। আমাকে বাঁচতে দাও।টাকা থাকতেও আমি কি তাকে বাঁচাতে পারি না?

না। না।.....এ আমি কি করছি ? "

মহিদুলের মাথাটা যেন কেমন করে উঠে।সে সাবিনার আর্তচিৎকার স্পষ্ট শুনতে পায়। না, আর এক বিন্দু সময়ও নষ্ট করতে চাই না আমি।ছুটে গিয়ে ডাক্তারকে করজোড়ে জানিয়ে দেয়,অনেক টাকা খরচা হলেও সেই টাকার জন্য চিন্তা করবেন না ডাক্তারবাবু। যত টাকা দরকার হয়, আমি দেবো।শুধু আমার ভাগ্নি কে বাঁচান। আমার ভাগ্নি কে বাঁচান...

... ঠিক আছে, আমরা চেষ্টা করে দেখব। ভেঙে পড়বেন না।শান্ত হোন।বলেই ডাক্তারবাবু ওটি তে চলে যায়।

দীর্ঘ 15 দিন ধরে যমে মানুষে টানাটানির পর মহিদুল ইসলাম প্রায় লাখ তিনেক টাকার বিল মিটিয়ে সাবিনার মুখে হাসি ফুটিয়ে নার্সিংহোম থেকে বেরিয়ে এলো।মহিদুলের শেষ ইচ্ছা পূর্ন না হলেও আজ আর তাঁর মনে কোন দুঃখ নেই।সে একজনের জীবন বাঁচাতে পেরেছে ..এটা ভেবেই এখন গর্ব অনুভব করে।মহিদুল সাবিনার হাতটি ধরে ভূপেন হাজারিকা-র গাওয়া "মানুষ মানুষের জন্যে, জীবন জীবনের জন্যে,.গানটি... আজ মামা ভাগ্নি একসাথে গাইতে গাইতে নতুনডি গ্রামের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়।

0 comments

Comentários


bottom of page