top of page
Writer's picturePrasenjit Konar

প্রাইভেট টিউশন

-বিতান সানা


দীর্ঘদিনের হাজারো অভিযোগ, হাজারো নীতি-নির্দেশিকা সত্ত্বেও এক শ্রেণির স্কুলশিক্ষকের প্রাইভেট টিউশন বন্ধ করা যায়নি। করোনা অতিমারিতেও কেউ কেউ অনলাইনে পড়িয়েছেন। লকডাউন উঠলে ফিরে গেছেন সেই পুরোনো অভ্যেসে।

মধ্যশিক্ষা পর্ষদের আচরণবিধিতেই বলা আছে, স্কুলশিক্ষক-শিক্ষিকারা টিউশন করতে পারবেন না। কিন্তু সেই বিধি আছে বিধিতেই! গত ২-৩ বছরে নানান পত্রপত্রিকায় এই নিয়ে নানান প্রতিবেদন বেরিয়েছে। নানান প্রাইভেট শিক্ষক সংগঠন এই বিধিভঙ্গের বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ করেছেন। সেই স্কুল শিক্ষকদের জিজ্ঞেস করা হলে কেউ বলেছেন তিনি এসব করেন না, বা কেউ বলেছেন আগে করতেন এখন ছেড়ে দিয়েছেন। আসলে এখনও তারা স্বমহিমায় টিউশন করিয়ে চলেছেন। নানান প্রাইভেট শিক্ষক সংগঠনের শিক্ষকরা সেই অভিযুক্ত স্কুল শিক্ষকদের তালিকাও তুলে দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট আধিকারিকদের কাছে। উপরিমহল থেকে সেই শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও ফল শূন্য। আসলে কেউই এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে ভেবে দেখতে চাননা। প্রাইভেট শিক্ষক সংগঠন বলতে সেই শিক্ষকদের বোঝাচ্ছি যারা কোনো স্কুল বা কলেজের সাথে যুক্ত নন, কেবল টিউশন করিয়েই যাদের সংসার চলে। এখানে বলে রাখা ভালো যে, বারবার শিক্ষক শব্দটা ব্যবহার করছি কারণ প্রাইভেট টিউশনটা মূলত শিক্ষকরাই করে থাকেন। শিক্ষিকারা নন।

দীর্ঘদিন ধরেই এই ব্যবসা চলছে। বাম আমলেও এর রমরমা ছিলো, তৃণমূলের আমলেও কোনো পরিবর্তন নেই। আমার ধারণা আগামীতে যে সরকারই আসুক না কেন, এর পরিবর্তন হওয়ার নয়। আমি বারাসাত প্যারিচরণ সরকার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র। একসময় আমিও এই ব্যবসার অংশ ছিলাম। ব্যবসা বলছি কারণ যেই শিক্ষাটা দেওয়ার জন্য তারা সরকারের কাছ থেকে বেতন পান, সেই শিক্ষাটার কিছু অংশ তারা স্কুলের সকল ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে থাকেন আর স্কুলের বাইরে টাকার মাধ্যমে আসল শিক্ষাটা তারা প্রাইভেট টিউশনে ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে থাকেন। আমাদের সময় কেউ কেউ পরীক্ষার প্রশ্নও বিলিয়ে দিতেন। স্কুলের ইউনিট টেস্টের বা ফাইনাল এক্সামের আগে প্রাইভেট টিউশনে যে প্রশ্নের ওপর পরীক্ষা নিতেন, হুবহু অনেক প্রশ্নই স্কুলের পরীক্ষায় চলে আসতো। এটা তখনই ঘটতো যখন সেই শিক্ষকই স্কুলের প্রশ্নপত্র তৈরি করতেন। এই কারণে অনেক ছাত্ররাই নির্দিষ্ট শিক্ষকদের কাছে প্রাইভেট টিউশন পড়তে যেত। ছাত্রদের মা বাবাও চাইতেন তাদের ছেলে ভালো মার্কস পাক। আমার মা বাবার ক্ষেত্রেও এর বদল ঘটেনি, বাবা না চাইলেও মা প্রাইভেট টিউশনের পক্ষপাতী ছিলেন। আমাদের স্কুলের অনেক শিক্ষকরাই স্কুলের শেষে নানান ছাত্রের বাড়িতে প্রাইভেট টিউশন পড়াতেন। কেউ কেউ আবার নিজের বাড়িতেই প্রাইভেট টিউশন সেন্টার খুলে পড়াতেন। ২০১৪ এর দিকে নবম-দশম শ্রেণীর সপ্তাহে একদিন করে টিউশন থাকতো। মাসের রেটটা ছিল এরম: বাংলা ২০০-২৫০ টাকা, ইংরেজী ২৫০-৩০০ টাকা, বিজ্ঞানের প্রতিটা বিষয় ২৫০ টাকা, ইতিহাস ২০০-২৫০ টাকা, ভূগোল ২৫০ টাকা। একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর বিজ্ঞান বিভাগের পড়া থাকতো সপ্তাহে দুদিন। রেটটা ছিলো বিজ্ঞান বিভাগের প্রতিটা বিষয় ৬০০-৮০০ টাকা, ইংরেজি- বাংলা ৪০০ টাকা। ইঞ্জিনিয়ারিং জয়েন্টের জন্য মাসের রেট ছিলো ১০০০-১২০০ টাকা। প্রাইভেট টিউশন পড়তে গিয়ে আমরা বন্ধুরা মিলে হিসেব করে দেখতাম একজন শিক্ষক মাসে কুড়ি-ত্রিশ হাজার বা কেউ কেউ চল্লিশ-পঞ্চাশ হাজার টাকা পর্যন্ত ইনকাম করছেন। কারণ তাদের অনেকেই অষ্টম শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত প্রাইভেট টিউশন পড়াতেন। প্রতিটা ক্লাসের অন্ততপক্ষে ২-৩টে ব্যাচ থাকতো।

স্কুলের প্রতিটা ক্লাস হতো ৪০ মিনিট করে, একজন শিক্ষক পড়িয়ে যাওয়ার পর আরেকজনের রুমে আসতে ৫-১০ মিনিট সময় লাগতো। ৩০-৩৫ মিনিটে আসলে সেইভাবে পড়া না হলেও, এমন অনেক শিক্ষকই ছিলেন যারা আন্তরিকতার সাথে ওই সময়টুকু পড়াতেন এবং তারা বাইরে প্রাইভেট টিউশনিও করতেন না।

কিছুদিন আগে আমার পাড়াত এক ভাইকে তার স্কুলের পড়া দেখাতে গিয়ে, আমার একটা অভিজ্ঞতা হয়। সেদিন বুঝেতে পারি ওর স্কুলে আসলে পড়াশুনাটাই ঠিকমতো হয়না। বাংলা অক্ষরই সে ঠিকমতো চেনেনা। সহজ বাংলা রিডিং পড়তেই সে হিমশিম খাচ্ছে। বারাসাতেরই একটি বাংলা মিডিয়ামের সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্র সে। ওর সাথে কথা বলে জেনেছিলাম ওই ক্লাসে ওর মতো ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা অনেক। কেবল গোনাকয়েক ছাত্রছাত্রীই প্রাইভেট টিউশনের দৌলতে ক্লাসে ভালো পারফর্ম করছে। আর্থিকভাবে সবল না হওয়ায় ওর সেই সুযোগটা হয়নি। তাই ক্লাস নাইনে এসেও বাংলা রিডিং পড়তেই সে হিমশিম খাচ্ছে।

বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের সরকারি বা সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলগুলোর প্রায় সকল ছাত্রছাত্রীরাই প্রাইভেট টিউশন পড়তে যায়। তারাও জানে স্কুলে ঠিকমতো পড়ানো হয়না, আর সেটার ওপর ভরসা করে থাকলে পরীক্ষায় ভালো মার্কস পাওয়া মুশকিল। ছাত্রছাত্রীদের বাবা-মাও তাই প্রাইভেট টিউশনিতে ছেলেমেয়েদের ভর্তি করিয়ে দেন, কেবল মার্কসের লোভে পড়ে। শেষমেশ পরীক্ষায় নাম্বারটিই গুরুত্বপূর্ণ কিনা। কলেজের ক্ষেত্রেও তাই। নন-টেকনিক্যাল কলেজে সকল ছেলেমেয়েরাই প্রাইভেট টিউশন পড়ে। টিউশনের আশপাশের জেরক্সের দোকানে গেলেই নোটসএর ফটোকপির বান্ডিল দেখতে পাওয়া যায়। এমন কি যারা প্রাইভেট টিউশন পড়ান, তাদের মধ্যে অনেকেই নানান কলেজে বর্তমানে প্রফেসর পদে রয়েছেন। সরকারের বেতনও নিচ্ছেন, এদিকে বাইরে টাকার বিনিময়ে ছেলেমেয়েদের নোটসও বিলি করছেন।

বর্তমানে প্রাইভেট টিউশন এতটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে যে, অনেকের ধারণা প্রাইভেট টিউশন না পড়লে আসল শিক্ষা লাভ হয়না। স্কুল-কলেজের তেমন গুরুত্ব নেই। সরকার বা প্রাইভেট সংস্থার স্কুল/কলেজ তৈরি করার কোনো প্রয়োজন নেই আসলে। স্কুল-কলেজ বর্তমানে শিক্ষার পরিবর্তে কেবল ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে রেজাল্টকার্ড আর ডিগ্রি সার্টিফিকেট নেওয়ার স্থান হিসেবে গণ্য হচ্ছে। যদিও প্রান্তিক ছেলেমেয়েদের জন্য স্কুল এখনো গুরুত্বপূর্ণ একটা স্থান কারণ পয়সা খরচ করে শিক্ষা নেওয়াটা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে আমার মনে হয় সরকারের নিজ উদ্যোগে প্রাইভেট কিছু টিউশন সেন্টার খুলে দেওয়া উচিৎ। ছেলেমেয়েদের আর কষ্ট করে স্কুল-কলেজে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। তারা সেন্টারে গিয়ে টাকার বিনিময়ে আসল শিক্ষাটা নেবে। যাদের সেই অর্থটা নেই তারা শিক্ষাটা নেবেনা। সরকারও এটাই চায়। টাকা না থাকলে কিসের শিক্ষা? বেশিরভাগ শিক্ষকরা এই 'অর্থ যার, শিক্ষা তার' পরিবেশটাই তৈরি করেছেন। সেই শিক্ষকেরা যারা স্কুলে বা কলেজে শিক্ষকের বা প্রফেসরের দায়িত্বে থেকেও বাইরে প্রাইভেট টিউশন করে এক্সট্রা রোজগার করেন, তাদের বেতন না দিয়ে সরকারের একেবারে ছাত্রছাত্রীদের হাতেই টিউশনের টাকাটা তুলে দেওয়া উচিৎ। তারাই টিউশন পড়ার পর মাস শেষে সেই শিক্ষকদের টিউশনের টাকাটা বেতন হিসেবে তুলে দেবে।

স্কুলে ছাত্রহিসেবে আমরা অনেকেই এই ব্যবসার অংশ ছিলাম, কিন্তু, এরমটা চলতে থাকলে আগামীর প্রজন্ম এটাই শিখবে যে স্কুলে/কলেজ পড়াশুনা করার জায়গা নয়, কেবল গিয়ে হাজিরা দেওয়ার জায়গা। সরকার যদি বাজেটে শিক্ষাখাতে আরও বরাদ্দ বাড়িয়ে প্রাথমিক থেকে উচ্চপ্রাথমিক, হাইস্কুলের শিক্ষার পরিকাঠামো আরও ভালো করে ছাত্রছাত্রীদের স্কুলের মধ্যেই উচ্চমানের শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করতো, তাদের প্রাইভেট টিউশন নেওয়ার কোনো প্রয়োজন পড়তো না। আজকাল আমরা অনেকেই ইউটিউবের নানান চ্যানেলে বিনামূল্যে আধুনিকভাবে শিক্ষাগ্রহণ করে থাকি। ছাত্রছাত্রীদেরকেও যদি সেই কায়দায় স্কুলে পড়ানো যেত, তাদের স্মৃতিতে আরো ভালোভাবে সেই বিষয়গুলো গেঁথে যেত বলে আমার মনে হয়। প্রাইভেট টিউশন পড়ার কোনো প্রয়োজন পড়তোনা। এছাড়া কলেজের ক্ষেত্রেও সিলেবাসে পরিবর্তন আনা বা এরম পরিকাঠামো বানানো দরকার যাতে কোনো ছাত্রছাত্রীকেই প্রাইভেট টিউশন না পড়তে হয়। স্কুল বা কলেজই হয়ে উঠবে প্রথাগত শিক্ষাগ্রহণের একমাত্র স্থান। আমার বিশ্বাস ভবিষ্যতে এরম একটা দিন আসবেই।

0 comments

Comentarios


bottom of page