top of page
Writer's picturePrasenjit Konar

পারমিতার যুদ্ধজয়

-বিতান সানা

আজ ফেব্রুয়ারির ১ তারিখ। নৃপেনবাবুর আজ পেনশনের টাকা তুলতে যাওয়ার দিন। প্রায় একবছর হলো নৃপেনবাবু অবসর নিয়েছেন। সকালে তাকে নীলিমাদেবীই ডেকে তুললেন। মনে করিয়ে দিলেন আজকে তার ব্যাংকে যাওয়ার দিন। এই পেনশনের টাকাতেই সারা মাসের সংসারটা চলবে। নৃপেনবাবু উঠে বসলেন, চা খেতে খেতে কোনো এক গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন তিনি। হঠাৎ করেই নীলিমাদেবীর ডাকে হুশ ফিরলো। বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লেন। হাত মুখ ধুয়ে টিফিন করে বেরিয়ে পড়লেন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।

পরিবারে নৃপেনবাবু আর তার স্ত্রী নীলিমাদেবী। তাদের একমাত্র মেয়ে পারমিতা তাদের সাথে থাকেনা। পারমিতা বাবা মার আপত্তি সত্ত্বেও হিন্দুমতে বিয়ে না করে কেবল কোর্ট ম্যারেজ করেছে। পারমিতার স্বামী সুরজিৎও এই বিষয়টিকে সমর্থন করে। কলেজজীবন থেকেই দুজনের প্রেম। সমাজের নানান অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার দেখে কলেজজীবন থেকেই তাদের মনে অনেক প্রশ্ন জেগেছিলো। সেই পরিস্থিতি থেকেই দুজনে সম্পূর্ণ বিজ্ঞানমনস্ক আর যুক্তিবাদী হয়ে ওঠে। ওরা নিজেদের মধ্যেই নানান বিষয় নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা করে, তর্ক-বিতর্ক করে। পারমিতার মা নীলিমাদেবীর এইগুলো কোনদিনই পছন্দ ছিলোনা। তিনি তার বাবা মার শেখানো রীতি-নীতি, অন্ধবিশ্বাস-কুসংস্কার গুলোকেই এতদিন লালনপালন করে এসেছিলেন। তিনি চাইতেন তার মেয়ে পারমিতাও সেগুলো মেনে চলুক। কিন্তু, পারমিতা প্রায়ই মায়ের সাথে তর্ক-বিতর্কে জড়িয়ে পড়তো, বিজ্ঞান আর যুক্তির ওপর ভর করে পারমিতা নিজের পয়েন্ট অব ভিউ রাখতে চাইলেও শেষমেশ নিলীমাদেবী নানান কৌশলে মেয়েকে বেকায়দায়ওরা ফেলে জিতে যেতেন। নৃপেনবাবু এসব বিষয়ে বেশি মাথা ঘামাতেন না ঠিকই, কিন্তু তিনিও মনে মনে চাইতেন তার মেয়ের বিয়েতে কন্যাদান করবেন, মেয়েকে উপহার হিসেবে নানান আসবাবপত্র, সোফা, আলমারি দিয়ে শশুরবাড়ি পাঠাবেন। কিন্তু, পারমিতা এইভাবে একজনকে বিয়ে করায় নৃপেনবাবু এবং তার স্ত্রী কেউই বিষয়টিকে মেনে নিতে পারেননি।

পারমিতা আর সুরজিৎ দুজনেই তাদের পরিচিত সার্কেলে যুক্তিবাদী আর বিজ্ঞানমনস্ক হিসেবেই পরিচিত। দুজনেরই মত যে, বিয়ের পর কন্যাদান কেন হবে? কন্যা কি বস্তু নাকি?

বিয়ের পর ছেলে সিঁদুর, শাখা, পলা পরবে না, অথচ কেবল স্ত্রীকেই সেটা পরতে হবে। বাহ্যিকভাবে একজন মহিলা বিবাহিত এটা বোঝা গেলেও, একজন পুরুষও বিবাহিত এটা বোঝা যাবেনা কেন? কেন এরম বৈষম্য?

বিয়ের দিন সারাদিন উপোস করে থাকতে হবে, খিদে পেলেও খাওয়া যাবেনা, কেন?

বিয়ের দিন ছেলের মায়ের বিয়েতে যাওয়া নিষেধ। নিজের ছেলের বিয়েতে কেন একজন মা যেতে পারবেন না?

বিয়ের সময় বর আর কনে আগুনের চারিপাশে ৭ পাক ঘুরে ৭টি প্রতিজ্ঞা করে, ৭জন্মের জন্য তারা বন্ধনে আবদ্ধ হয়, কিন্তু, কোন কারণে মনের অমিল হলে ডিভোর্সটা সেই কোর্টেই হয়। ৭ জন্মের সমস্ত প্রতিজ্ঞা, প্রতিশ্রুতি সব ধুলোয় মিশে যায়। তবে কেন কেবল কোর্ট ম্যারিজই বিয়ের একমাত্র মাধ্যম হবেনা?

এরম একাধিক প্রশ্নের যুক্তিযুক্ত জবাব কেউ দিতে পারেনি তাদের। কেবল "নিয়ম" বলেই সকলে এড়িয়ে গেছে। পারমিতা আর সুরজিৎ দুজনেই বিয়ের সময় মেয়ের বাবামায়ের নানান উপহার দেওয়াকেও একধরণের পণের চোখেই দেখে।

পারমিতা বর্তমানে একটি সাংবাদপত্রের উচ্চপদে আসীন আর সুরজিৎ একটি বেসরকারি ফার্মাসি কোম্পানিতে। পারমিতার শশুর বেঁচে নেই। তবে ওর শাশুড়ি এসব বিষয় নিয়ে পূর্বে ছেলে আর বৌমার সঙ্গে কথাকাটাকাটি, তর্কাতর্কি করলেও, এখন আর সেরম পরিস্থিতি নেই। ছেলে আর বৌমার সংস্পর্শে এসে তিনিও বাস্তবটা বুঝতে শিখেছেন।

বিয়ের পর পারমিতা অন্যত্র থাকলেও, ওর বাবা মার সাথে ওর কোনো সম্পর্ক নেই। প্রায় ৩-৪ বছর হতে চললো নীলিমাদেবী ধরেই নিয়েছেন তার কোনো মেয়ে নেই। তিনি এখনও জেদ ধরে আছেন, আর ভাবছেন নিয়ম করে বিয়ে না করায় ওদের সম্পর্কটা বেশিদিন টিকবেনা।

নৃপেনবাবু বেসরকারি একটি কোম্পানিতে চাকরি করতেন। বেতন যা পেতেন তাতে তাদের সকলের কোনোরকমে চলে যেত। এই পরিস্থিতিতে তিনি চেয়েছিলেন ভালো চাকরিওয়ালা, জাতের পাত্র পাওয়া গেলে মেয়েকে কলেজে পড়াকালীনই বিয়ে দিয়ে দেবেন। কিন্তু, পারমিতা ছিলো নাছোড়বান্দা। ওর ইচ্ছে ছিলো সাহিত্য নিয়ে মাস্টার্স করার, তারপর নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে নিজের পছন্দের কাউকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেবে। বাবা মার তাতে সায় না থাকলেও, একরকম জেদের বশেই সে যুদ্ধ করে ওর মাস্টার্সটা শেষ করেছিলো।


নৃপেনবাবুর অবসরের পর বেসরকারি সংস্থা যে পেনশনের টাকাটা তাকে দিয়েছে সেটা খুবই সামান্য। সেই অর্থে দুজন মানুষের মাস চালানো প্রায় অসম্ভব। মাসের শুরুতে তিনি যে অর্থটা নিয়ে বাড়ি ফেরেন সেটা আদৌ ব্যাংকের থেকে উইথড্র করা অর্থ নয়। নীলিমাদেবীকে সেটা এখনও অবদি জানাননি নৃপেনবাবু।

গন্তব্যে এসে নৃপেনবাবু দাঁড়িয়েই ছিলেন, একটা ৪ চাকার এসইউভি এসে তার সামনে দাঁড়ালো। গাড়ি থেকে নেমে এলো একটি মেয়ে। একটা খাম নৃপেনবাবুর হাতে ধরিয়ে দিলো সে।

নৃপেনবাবুও এক গাল হেসে, " ভালো থাকিস মা " বলে মেয়েটিকে বিদায় জানিয়ে বাড়ির পথ ধরলেন।

মেয়েটি গাড়িতে উঠে পড়লো। মেয়েটিকে সংবাদপত্রের অফিসে ফিরতে হবে যে।


নৃপেনবাবু না বললে নীলিমাদেবী হয়তো কোনোদিন জানতেও পারবেন না, ওই খামের কুড়ি হাজার টাকা আসলে তারই মেয়ে পারমিতার বেতনের অংশ।


0 comments

Comments


bottom of page