প্রবন্ধ ও নিবন্ধ:
• ভূত চতুর্দশী ও ব্যবসা -ক্রান্তিকারী শুভাশিষ/০৪
• এক-এ চন্দ্র, দুই-এ পক্ষ -জামাল আনসারী/০৬
• মৃত মানুষের নাভিকুন্ড কি অদাহ্য? -কৃষ্ণ ঘোষ/০৯
• বিয়ে করা কি উচিৎ না কি ভুল হবে? অনুবাদক- নির্মাল্য দাশগুপ্ত/১১
• কলকাতার জলাভূমি এবং এক পরিবেশবিদ -সৌরদীপ চ্যাটার্জী/১৪
• সাম্প্রদায়িকতার বিষ -শীলা মোস্তাফা/১৮
• সংকটে নাগরিকত্ব! -স্বর্ণাভ ভট্টাচার্য/২০
কবিতা:
দেরি -প্রদীপ চক্রবর্তী/২৮
দুর্গা-কোরান -অমিতাভ ভট্টাচার্য/২৯
এই যে তুমি মস্ত মুমিন, মুসলমানের ছেলে -আখতারুজ্জামান আজাদ/৩০
জ্যোতিষ শাস্ত্র ও দেশসেবা -নির্মল/৩২
বাংলাদেশে দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে যে চরম হিংসা বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ে তার তীব্র প্রতিবাদ জানাই, প্রচুর মানুষ মৌলবাদের বিপক্ষে কলম ধরেন এটুকুই আশার কথা। ধর্মান্ধতা কিভাবে মানুষকে অন্ধ করে দেয় তা আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো। আমরা যারা মুক্তচিন্তার চর্চা করছি তাদের আরও পাশাপাশি থাকার প্রয়োজনীয়তা এই কঠিন সময়ে অত্যন্ত অনুভব করছি। সবাই নিয়মিত লেখা-লেখির চর্চায় থাকুন। মৌলবাদের বিরুদ্ধে কলম চলতে থাকুক। ধন্যবাদ।
ভূত চতুর্দশী ও ব্যবসা
-ক্রান্তিকারী শুভাশিষ
ভূত চতুর্দশী। বাঙালির হ্যালোইন। কুমড়োর লণ্ঠন তৈরি, ঘর সাজানো, ছোট ছোট বাচ্চারা নানা বিচিত্র পোশাক পরে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ানো এইসব নানাবিধ কার্যকলাপের মাধ্যমে উৎসবের মেজাজে বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তে হ্যালোইন পালিত হলেও বাংলায় ভূত চতুর্দশী পালিত হয় যথেষ্ট নিষ্ঠাভরে। যদিও উভয় ক্ষেত্রেই বিশ্বাস থেকেই জন্ম নিয়েছে এই উৎসব। বিশেষ ধর্মালম্বী মানুষজনদের মতে দীপান্বিতা অমাবস্যার আগের দিন অর্থাৎ কার্তিক মাসের কোজাগরী পূর্ণিমার পরবর্তী চতুর্দশী তিথির দিনটিকে বলা হয় ভূত চতুর্দশী। ভূত চতুর্দশী নিয়ে নানা পৌরাণিক গল্প কথা থাকলেও মূল বিষয় হল এই দিন মৃত পূর্বপুরুষরা ধরাধামে নেমে আসে। তাই এত আয়োজনের ঘনঘটা। এই দিন দিনের বেলায় ১৪ রকমের শাক খেয়ে রাতে ১৪ প্রদীপ জ্বালিয়ে নিষ্ঠাভরে পালন করার রেওয়াজ বঙ্গবাসীর দীর্ঘদিনের।
এ তো গেল বিশ্বাসের কথা। কিন্তু এই ভৌতিক বিশ্বাসকেই এক শ্রেণীর প্রচারমাধ্যম সুকৌশলে বিকিকিনির উপকরণে পরিণত করেছে। একটা সময় অবধি ভূত-প্রেত-আত্মা এই সমস্ত বিষয়গুলি নির্দিষ্ট কিছু উপন্যাস, গল্পের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে অবস্থাটা অন্যরকম আকার নিয়েছে। সংবিধানের 51A(h) ধারাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে একশ্রেণীর প্রচারমাধ্যম অধিক মুনাফার আশায় প্রতিবার এই সময়ে এমন কিছু সংবাদ পরিবেশন করে যা শুধু নিন্দনীয় নয়, বিজ্ঞানমনস্কতা প্রসারে পরিপন্থী। গত বছরই বহুল প্রচারিত সংবাদপত্রের শিরোনামে উঠে আসে "হদিস মিলল সাত রকম আত্মার, ভূত খুঁজতেই ঘাড় ধাক্কা।" সেই সাথে জুড়েছে কোনো প্রাচীন ঐতিহাসিক স্থান, বসতিহীন রাজবাড়ী, পরিত্যক্ত রেলস্টেশন গুলিকে 'Ghost Tourism' -এ রূপান্তরিত করার নতুন পন্থা। বেগুনকোদর তার জ্বলন্ত উদাহরণ। অনুঘটক হিসাবে উদয় হয়েছে একদল ভূত বিশেষজ্ঞ। যাদের পোশাকি নাম 'প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেটর'। আধুনিক বিজ্ঞানের কিছু যন্ত্রপাতিকে সম্বল করে মানুষকে সুকৌশলে বোকা বানানোর চেষ্টা রীতিমতো উদ্বেগজনক। সেই সাথে রোমাঞ্চপ্রিয় মানুষদের কৌতূহলকে পাথেয় করে কখনও কখনও বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমে এইসব প্যারানর্মাল ইনভেস্টিগেটররা লাইভে আত্মার অস্তিত্ব দেখানোর চেষ্টায় এগিয়ে চলেছে। আমরা এই ঘটনা চাক্ষুষ করেছি বাঙালির ঘরে ঘরে ঠাঁই পাওয়া জি বাংলার অন্যতম জনপ্রিয় টিভি শো দাদাগিরিতে; যা নিয়ে বিতর্কের অবসান এখনো ঘটেনি। এই কাণ্ডকারখানা যুক্তিবাদীদের কাছে হাস্যকর মনে পারে, কিন্তু বিষয়টি ভাববার। তার সাথে সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্রমাগত বেড়ে চলা অপবিজ্ঞান চর্চা তো আছেই। রাষ্ট্রের পরিচালন ব্যবস্থা এক্ষেত্রে ঠুঁটো জগন্নাথ।
বিশ্বাসের সঙ্গে যুক্তির অনিবার্য সংঘাত হিসাবে যুক্তিবাদীদেরকে এই বিষয়ে আরো বেশি অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। কখনও কখনও দেখা যায় এই বিশ্বাসকে অপযুক্তির হাত ধরে উপরে ওঠার চেষ্টা করে, একটি ধারণা তৈরী করে। কিন্তু সেই অপচেষ্টাকে আমাদের যুক্তি দিয়ে মোকাবিলা করতেই হবে। অনেকে ১৪ শাক খাওয়ার স্বপক্ষে যুক্তি হিসেবে খাড়া করেন, ঋতু পরিবর্তনের সময় ১৪ শাক খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো, বিশেষ করে তা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির সহায়ক। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে, কীভাবে একটি বিশেষ দিনে ১৪ রকমের শাক কিঞ্চিৎ পরিমাণ গ্রহণের মধ্যে দিয়ে বিপুল পরিমাণ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠবে? তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। প্রশ্ন উঠবে শুধুমাত্র ঐ দিনেই কেন? আগে বা পরে নয় কেন? প্রশ্ন ওঠা উচিত একইভাবে ১৪ প্রদীপ জ্বালানোর ক্ষেত্রেও তাদের দেওয়া যুক্তির। প্যারানর্মাল ইনভেস্টিগেটরদের ব্যাপারে বলি, এই সমস্ত প্রতারকদের যতবার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি ডাকা হয়েছে তাদের টিকি পাওয়া যায়নি। তাই সচেতন নাগরিক হিসেবে প্রত্যেকের সংবিধানের 51A(h) ধারার গুরুত্ব বুঝে এই সমস্ত মিথ্যা বিভ্রান্তিকর অপবিজ্ঞান সংবাদ শেয়ার করা থেকে বিরত থাকা বাঞ্ছনীয়। সবজান্তা মধ্যবিত্ত মানসিকতা লোকজনদের পাত্তা না দিয়ে এইসব অপবিজ্ঞানের বিরুদ্ধে বিজ্ঞানমনস্কতার মশাল জ্বালতেই হবে।
এক-এ চন্দ্র, দুই-এ পক্ষ
-জামাল আনসারী
একটি শিশুর প্রথম লেখাপড়ার হাতেখড়ি বর্ণ পরিচয়। সাথে সাথে শিশুটি বিভিন্ন সংখ্যা গোনা শিখতে থাকে।এ গুলো শিশুর সহজ সরল কোমল মনে এবং বিশ্বাসে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে। এই বর্ণ পরিচয় ও বিভিন্ন সংখ্যা গোনার সময় থেকেই জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে শিশুর মনে কিছু আজগুবি, অবিশ্বাস্য, পৌরাণিক ধর্মীয় কুসংস্কারের ধ্যান ধারণা মস্তিষ্কের রন্ধে রন্ধ্রে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। আসুন আমরা খোলামেলা মনে সেগুলো আলোচনা দেখি-
১- এক- এ চন্দ্র।চন্দ্র মানে চাঁদ। আমরা সকলেই জানি আমাদের পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ হল চাঁদ। তাহলে এক-এ চন্দ্র বলতে একটি চাঁদকে বোঝাচ্ছে। এটা ঠিক আছে। কোনো ভুল নেই।
২- দুই-এ পক্ষ। পক্ষ মানে এখানে কোনো বর পক্ষ বা কনে পক্ষের কথা বলা হয়নি,শত্রুপক্ষ, মিত্রপক্ষ নয় ।বাংলা অভিধানে পক্ষ শব্দের অর্থ দেওয়া আছে “চাঁদের বৃদ্ধিকাল বা হ্রাসকাল (শুক্লপক্ষ, কৃষ্ণপক্ষ); প্রতিপদ থেকে পূর্ণিমা বা অমাবস্যা তিথি পর্যন্ত সময়; মাসার্ধ, পনেরো দিন (তিনি এক পক্ষকাল বিদেশে থাকবেন)।”
এখানে দুই-এ পক্ষ বলতে মাসের দুটি (মাসার্ধ)পক্ষকে বোঝানো হয়েছে। এই পক্ষ দুটি হল কৃষ্ণপক্ষ এবং শুক্লপক্ষ।
৩-তিন-এ নেত্র। নেত্র শব্দের অর্থ সংসদ বাংলা অভিধানে লেখা আছে চক্ষু।
এখন তিন-এ নেত্র বলতে এখানে তিনটি চক্ষুর কথা বলা হয়েছে। সমস্যাটি এখানেই।গোটা বিশ্ব তন্ন তন্ন করে খোঁজ করলেও কোনো মানুষ তো দূরের কথা। গরু, ছাগল, হাঁস মুরগী, কোনো পশু পাখির মধ্যে কারোও তিনটি চোখ খুঁজে পাওয়া যায় না। এখানে আজগুবি, অবিশ্বাস্য, গল্পের গরু গাছে চড়ে মার্কা পৌরাণিক গল্প গুলো টেনে আনা হয়েছে। পৌরাণিক গালগল্পে আছে পৃথিবীর যতসব আষাঢ়ে গল্প গুলোর আঁতুরকুড়। পুরানেই পাওয়া যায় কারো জন্ম মাথা থেকে তো কারো জন্ম পা থেকে। কেউ উরু থেকে, কেউ আবার বাহু থেকে জন্ম গ্রহন করে। যতসব হাস্যকর অবৈজ্ঞানিক কান্ডকারখানা! এমন কি চোখের জল থেকে; কান থেকেও মানুষের জন্ম হওয়ার কথা পুরানে লেখা আছে। সেই পৌরাণিক কাহিনীতে শিবের তিনটি চোখের কথা বলা আছে। তাছাড়া কিছু পুরানে দুর্গার তিনটি চোখের কথা বলা হয়েছে। এটা নিয়েও নানা মুনির নানা মত। বির্তকিত বিষয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে শিশু মনে কেন এই অবৈজ্ঞানিক, বিতর্কিত বিষয় গুলো ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে? এর উদ্দেশ্যই বা কি তা পাঠকদের ভেবে দেখতে অনুরোধ করছি।
৪- চার এ বেদ। আমরা জানি বৈদিক যুগে চারটি বেদ ছিল। এই চারটি বেদ হল- 1) ঋক 2) সাম 3) যজু 4) অথর্ব। ঘুরে ফিরে সেই পৌরাণিক বিষয়। ছোট্ট ছোট্ট শিশুদের কি এগুলো জানা খুব প্রয়োজন? পাঠকগণ একটু ভেবে দেখবেন।
৫-পাঁচ এ পঞ্চবাণ। বাণ শব্দের অর্থ বাংলা অভিধানে লেখা আছে, ধনুক থেকে যে তীক্ষ্ণাগ্র অস্ত্র নিক্ষিপ্ত হয়, তির, শর। হিন্দু ধর্ম অনুসারে কামদেব অথবা মদন দেবের পাঁচটি বানের কথা বলা হয়ে থাকে। এই পাঁচটি বাণ হল- ১) সম্মোহন 2) তাপন 3) শোষণ 4) উন্মাদন 5) স্তম্ভন। এখানেও সেই সহজ সরল শিশুর মনে ও বিশ্বাসে ধর্মীয় বিষয় পরিকল্পনা মাফিক ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। ধীরে ধীরে শুরু হয় ধর্মীয় কুসংস্কারের পাঠ। পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে জানা যায়, এযাবৎ পৃথিবীতে লড়াই ঝগড়া করে যত মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তার সংখ্যাধিক্য মানুষের মৃত্যু হয়েছে ধর্মের কারনে। তাই ছোট্ট ছোট্ট সহজ সরল শিশুদের লেখাপড়ার হাতেখড়িতেই ধর্মীয় শিক্ষার পাঠ কেন?
৬- ছয়-এ ঋতু। আমরা যারা ভূগোল বই পড়েছি,তারা সময় জানি যে, গোটা বছরকে ছয়টি ঋতুতে ভাগ করা হয়েছে। এই ছয়টি ঋতু হল- 1) গ্রীষ্ম 2) বর্ষা 3) শরৎ 4) হেমন্ত 5) শীত 6) বসন্ত। এটা সত্যি। এটা মানতে কারো অসুবিধা নেই।
৭- সাত-এ সমুদ্র। বাংলা অভিধানে সমুদ্র শব্দের অর্থ দেওয়া আছে-সাগর, অর্ণব, দরিয়া, জলধি, বারিধি, অম্বুনিধি, প্রচেতা, জলেন্দ্র, জলেশ্বর, জলারণ্য, জলধর, নীলাম্বু, মকরালয়, মকরাকর, নীরধি, পয়োধি, জলাধিপ, বারিধর, বারিনিধি, বারীন্দ্র, বারীশ প্রভৃতি।
এখানে সাত-এ সমুদ্র বলতে সাতটি সমুদ্র বা সাগরের কথা বলা হয়েছে। এই সাতটি সমুদ্র কোথায় অবস্থিত? বিভিন্ন দেশের ভূগোল বইয়ে খোঁজ করলে দেখা যাবে। মহাসাগর আছে, সাগর আছে ,উপসাগর আছে। কিন্তু কোনোটিই সংখ্যায় সাতটি নয়।এই পৃথিবীতে সমুদ্র বা সাগরের সংখ্যা মোট সাতটি নয়। আরো বেশি। উইকিপিডিয়া অনুসন্ধান করলে অনেক সাগর বা সমুদ্রের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। যেমন-
লোহিত সাগর, বঙ্গোপসাগর, আরব সাগর, তিমুর সাগর, জাপান সাগর, দক্ষিণ চীন সাগর, জাভা সাগর, মৃত সাগর, বেরিং সাগর, কৃষ্ণ সাগর প্রভৃতি। কিন্তু সাত-এ সমুদ্র এগুলো নয়।
সাত-এ সমুদ্র হল,আমাদের দেশের পুরাণে বর্ণিত সাতটি সমুদ্রের নাম। এগুলি হল – লবণ, ইক্ষুরস, সুরা, ঘৃত, দধি, ক্ষীর ও মিষ্টি
হ্যাঁ। এগুলিকেই সমুদ্র বলে মানতে হবে। শিখতে হবে। বাচ্চাদের শেখাতে হবে। আচ্ছা, শিশুদের সংখ্যামালা শেখার সাথে সাথে এই ভুল ধ্যান ধারণা গুলি কেন শিখতে হবে? সচেতন পাঠকদের এটাও ভেবে দেখতে অনুরোধ করছি।
৮ - আটে অষ্টবসু। অষ্ট বসু মানে আট জন বসুর কথা বলা হয়েছে। মহাভারত অনুযায়ী দক্ষ রাজার কন্যা বসুর গর্ভজাত আটপুত্রকে বলা হয় অষ্টবসু। তাঁরা হলেন- 1) ধর 2) ধ্রুব 3) সোম 4) অহ 5) অনিল 6) অনল 7) প্রত্যুষ 8) প্রভাস বা দ্যু। বলা হয় এই অষ্টবসুরাই ইন্দ্রের সহকারী, পরবর্তীতে তারা বিষ্ণুর সহকারী হন।
অষ্টবসুর এক বসু প্রভাস বা দ্যু যিনি মাতা গঙ্গা ও শান্তনুর পুত্র রূপে দেবব্রত নামে মর্ত্যে জন্মগ্ৰহণ করেন। পরে তার ভীষণ প্রতিজ্ঞার কারণে ভীষ্ম নামে পরিচিত হন।
বৃহদারন্যক পুরাণ অনুযায়ী অষ্ট বসু হচ্ছে- 1) পৃথিবী 2) অগ্নি 3) বায়ু 4)অন্তরীক্ষ 5) আদিত্য 6) চন্দ্রমা 7) নক্ষত্রাণি 8) দ্যু।
এখানেও সেই বির্তকিত বিষয়ের অবতারণা। একটার সাথে একটার কোনও মিল নেই! তবুও শিখতে হবে।পড়তে হবে। শিশুদের শেখাতে হবে! কিন্তু কেন?
৯- নয়-এ নবগ্রহ। নবগ্রহ মানে নয়টি গ্রহ। বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনীতে নয়টিগ্রহের কথা বলা হয়েছে। সেগুলি হল রবি, চন্দ্র, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি, রাহু ও কেতু।
এখানে রবি অর্থাৎ সূর্যকে পুরানে গ্রহ বলা হয়েছে। কিন্তু রবি তো একটি নক্ষত্র। আমরা জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে শিশুদের ভুল শিক্ষা দিচ্ছি। তাছাড়া রাহু ও কেতু নামে কোনো গ্রহের অস্তিত্ব এই সৌরজগতে নেই। তবুও আমরা নয়টি গ্রহের মধ্যে রাহু কেতুকে রেখেছি। কারন পুরানে আছে। তাই রাহু, কেতু কে গ্রহ বলেই মানতে হবে। পড়তে হবে। শিখতে হবে।বাচ্চাদের শেখাতে হবে। কিন্তু কেন?
হিন্দু ধর্মের পুরাণ অনুসারে, "সমুদ্র মন্থনের সময় রাহু (স্বরভানু) নামক এক অসুর লুকিয়ে দিব্য অমৃতের কয়েক ফোঁটা পান করে। সূর্য্য ও চন্দ্রদেব তাকে চিনতে পেরে মোহিনী অবতাররূপী ভগবান বিষ্ণুকে জানায়। তৎক্ষণাৎ, অমৃত গলাধঃকরণের পূর্বেই বিষ্ণু আপন সুদর্শন চক্রের মাধ্যমে রাহুর ধড় থেকে মুন্ড ছিন্ন করে দেন। অমৃত পানের জন্য মুন্ডটি অমরত্ব লাভ করে এবং এভাবেই রাহু গ্রহটির উৎপত্তি হয়; (এই ভাবে কি কোনো গ্রহের জন্ম হতে পারে?) বাকী মুন্ডহীন দেহটির নাম হয় কেতু। সূর্য্য ও চন্দ্রের প্রতি বিদ্বেষের কারণে বছরের নির্দিষ্ট সময় অন্তর রাহু এদেরকে গ্রাস (গ্রহণ) করে ফেলে। কিন্তু এই গ্রহণের পর সূর্য্য ও চন্দ্র রাহুর কাটা গ্রীবা থেকে আবার বেরিয়ে আসে। এই ভাবেই সূর্য গ্রহণ ও চন্দ্র গ্রহণ হয়” যা একটি অবৈজ্ঞানিক মতবাদ।
আমরা ভূগোল বইয়ে পড়েছি সৌরমণ্ডলের কথা।সৌরমন্ডলে যে নয়টিগ্রহের নাম রয়েছে সেগুলি হল – বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস, নেপচুন ও প্লুটো। যদিও তার মধ্যে বর্তমানে প্লুটোকে গ্রহের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। প্লুটোকে বলা হয় বামন গ্রহ। ভেবে দেখুন, একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নতির পরও আমরা কি পৌরাণিক গালগল্প গুলো মানব না বিজ্ঞান মানব! বাচ্চাদের স্বার্থে এ কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার
১০-দশ-এ দিক। দশটি দিকের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই দশটি নাম হল পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ, ঈশান, বায়ু, অগ্নি, নৈঋত, উর্ধ এবং অধঃ। এটা সত্যি। তাই এটা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই।
সময়ের সাথে বিজ্ঞানের সাথে তাল মিলিয়ে চলায় বুদ্ধিমানের কাজ। পরিশেষে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি রূপক কবিতার কয়েকটি লাইন নিম্নে উদ্ধৃতি করে এই লেখা শেষ করছি।
“যে নদী হারায়ে স্রোত চলিতে না পারে
সহস্র শৈবালদাম বাঁধে আসি তারে;
যে জাতি জীবনহারা অচল অসাড়
পদে পদে বাঁধে তারে জীর্ণ লোকাচার।”
ঋণ স্বীকার:
বাংলা অভিধান।
কয়েকটি পুরাণ গ্রন্থ।
উইকিপিডিয়া।
মৃত মানুষের নাভিকুন্ড কি অদাহ্য?
-কৃষ্ণ ঘোষ
মানবদেহ অবিনশ্বর নয়। মারা যাওয়ার পর আমাদের দেহের সমগ্র অংশ মাটিতে বিলীন হয়ে যায়। বিলীন হয়ে যাওয়াটা ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে হয়। কোনও দেহ পুড়ে ছাই হয়ে মাটিতে মিশে যায়। আবার কোনও দেহ মাটিতে পচে গলে মিশে যায়। এসব তথ্য আমরা সবাই জানি। এসব জানার মাঝেও আমরা দু একটা তথ্য ভুল জানি। যেমন, মৃত মানুষের নাভিকুন্ড নাকি কখনওই পোড়ে না। এই নিয়ে বেশ কিছু মানুষের সাথে আলোচনা করে দেখেছি,কেউ কেউ মানলেও অনেকেই মানতে চান না মানুষের নাভিকুন্ড পোড়ে বলে। দিন কয়েক আগে ফেসবুকেও একজন এই বিষয়ে প্রশ্ন রেখেছিলেন। সেখানেও দেখলাম,অনেকেই নিজের নিজের অভিজ্ঞতা পরিবেশন করে জানিয়েছেন, নাভিকুন্ড পোড়ে না। এমন কি ইলেকট্রিক চুল্লিতেও নাকি মৃত মানুষের নাভিকুন্ড পোড়ে না। কথা প্রসঙ্গে আমাদের এক বন্ধু তো তার সারা জীবনে তিনি কত মরা পুড়িয়েছেন,সেই হিসেব দেখিয়ে প্রমাণ করতে চাইলেন মৃত মানুষের নাভিকুন্ড কখনওই পোড়ে না। কেউ যদি তার নিজের অবস্থানে অনড় অটল থাকে,তবে তাকে কিছুতেই বোঝানো যায় না। বেশি কিছু বলতে গেলে অপ্রীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়।
শ্মশানে মৃতদেহ পোড়ানো দেখার অভিজ্ঞতা আমাদের প্রায় সকলেরই কমবেশি থাকলেও মানুষের নাভিকুন্ড পোড়ে কি পোড়ে না,এই নিয়ে আমরা কেউই তেমন একটা ভেবে দেখিনি। মরা পোড়ানো হয়ে যাওয়ার পরে শ্মশানের ডোম 'অস্তি' হিসাবে গনগনে চিতা থেকে কিছু একটা পোড়া অংশ সদ্য প্রয়াত মানুষের নিকটজনের হাতে তুলে দেন। ওটাই নাকি মৃত মানুষটির নাভিকুন্ড। এমনটাই আবহমান কাল ধরে চলে আসছে। এর মধ্যে বড় শহরগুলিসহ জেলায় জেলায় ইলেকট্রিক চুল্লির প্রচলন হলেও 'নাভিকুন্ড' পোড়ে না,এমন একটা ভ্রান্ত ধারণার খুব একটা বদল ঘটেনি। কিন্তু কেন এমন ভ্রান্ত ধারণা আজকের দিনেও বিরাজমান মানুষের মনে ? এই নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক।
যেখানে আগুনের তাপে লোহা জলের মতো তরল হয়ে যায়,সেখানে নাকি মানুষ নামক প্রাণীর নাভিকুন্ডলি পোড়ে না ! এই রকম ধারণা পোষণ করার মধ্যে আছে আমাদের আজন্ম লালিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানসিকতা। সুদূর অতীতে অল্প কিছু করেকম্মে খাওয়া স্বঘোষিত ব্রাহ্মণ তকমাধারী মানুষদের তৈরী করা সংস্কারকে অনুসরণ করে পোড়া কাঠ কয়লা মাখানো অর্ধদগ্ধ একটা টুকরোকে শ্মশানের ডোমেরা মৃতের পরিবারের হাতে তুলে দেয়। ওটা আদৌ নাভিকুন্ড, নাকি অন্য কোনও আধা পোড়া দেহাংশ,এ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার মতো মানসিকতা মৃতের পরিবারের তো থাকেই না,অন্য কোনও মানুষের ইচ্ছে থাকলেও করতে পারেন না অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। তাই আবহমান কাল ধরে চলে আসছে এমন ভ্রান্ত ধারণা। মানুষের নাভিকুন্ড কখনওই পোড়ে না,এমন জল্পনা শ্মশানের চৌহুদ্দির মধ্যেই হয়। বিজ্ঞানের ল্যাবরেটরিতে বোধহয় কখনও এমন গবেষণা হয়নি।
কিছু অতি সাধারণ বিষয় আছে,যা বুঝতে ও বোঝাতে কোনও বিরাট কিছু বিদ্যা শিক্ষা জ্ঞান কিম্বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার প্রয়োজন হয় না। এসব ক্ষেত্রে একেবারে সাধারণ কান্ডজ্ঞানই যথেষ্ট। মানুষের নাভিকুন্ড পোড়ে কি পোড়ে না,এটা সেই রকমই একটা সাধারণ বিষয়।
ধরা যাক, কোনও একজন মানুষকে যদি প্রশ্ন করা হয়,একটা লোহার টুকরো এবং এক টুকরো মাংস কোনও গনগনে জ্বলন্ত ফার্নেসের মধ্যে একসঙ্গে ছুঁড়ে দিলে কোনটা আগে পুড়ে যাবে ? এমন প্রশ্ন শুনে উত্তরদাতা প্রশ্নকর্তার দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকাবে,এমন একটা উদ্ভট প্রশ্ন করার জন্য।
কিন্তু যদি 'এক টুকরো মাংসের' পরিবর্তে 'এক টুকরো মানুষের নাভিকুন্ড' কথাটা বসিয়ে প্রশ্ন করা হয় তবে তিনিও একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়বেন। কারণ,তিনি যত বড় শিক্ষিত হোন না কেন, তিনি তার বংশ পরম্পরায় জেনে এসেছেন,দেখে এসেছেন মানুষের নাভিকুন্ড পোড়ে না। কেন পোড়ে না,এটা নিয়ে তেমন কেউই ভেবে দেখেনি বা দেখতে চান না। কারণ,এই নাভিকুন্ড নিয়ে অস্তি বিসর্জনের মতো একটা পারলৌকিক আচার ও সংস্কার আছে। তাই সংস্কারটির পিছনে আমাদের আজন্ম লালিত ভ্রান্ত ধারণাও কাজ করে।
উপযুক্ত তাপমাত্রায় এবং পর্যাপ্ত সময়ে যেখানে সবচেয়ে কঠিন ধাতু হীরের টুকরোও পুড়ে যায়,সেখানে সামান্য নাভিকুন্ড তো কোনও ব্যাপারই নয়। আমাদের শরীরের অন্যান্য অংশের তুলনায় নাভিকুন্ডে চর্বি জাতীয় পদার্থ অনেক বেশি পরিমাণে থাকে। তাই পুড়তে কিছুটা সময় নেয়। কিন্তু পোড়ে। নাভিকুন্ড পোড়ে না,এমন ধারণাটা সম্পূর্ণ ভুল। কাঠের চিতায় একটা মৃতদেহ পোড়াতে প্রায় আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা সময় লেগে যায়। এই সময়ের মধ্যে সারা দেহের অন্যান্য অংশ পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও দেহের চর্বি জাতীয় অংশ ঠিক মতো পোড়ে না। এছাড়া অস্তি নেওয়ার মতো একটা সংস্কার কাজ করে। ফলে,খুব সহজেই নাভিকুন্ড 'অদাহ্য পদার্থ' হিসেবে মর্যাদা পেয়ে যায়।
একটা খুব সহজ সরল উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যাক বিষয়টি। কিছুটা বদ্ধ জায়গায় একটা A4 সাইজের কাগজ হাতে নিয়ে কাগজটির যে কোনও একটা কোণায় আগুন লাগিয়ে মাটিতে রেখে দিন। কিছু ক্ষণের মধ্যেই দেখবেন,কাগজটার অধিকাংশ অংশ পুড়ে গেলেও মাটিতে লেগে থাকা কিছুটা অংশ পোড়েনি। এই ভাবে আপনি দশ বারোটা কাগজ একটা একটা করে পোড়াতে গিয়ে লক্ষ্য করে দেখবেন, একেবারে সম্পূর্ণ কোনও কাগজই ঠিক মতো পুড়ছে না। কোনও না কোনও অংশ বাকি থেকে যাচ্ছে। অথচ ওই একই সাইজের কাগজ আপনি হাতে ধরে রেখে যদি পোড়াতে যান অথবা কোনও জ্বলন্ত উনুনে ছুঁড়ে দেন,তাহলে দেখবেন মুহূর্তের মধ্যে কাগজটা পুড়ে যাচ্ছে। এইবার ধরুন, কোনও ধর্মগুরু যদি আগুনের এই স্বাভাবিক নিয়মটিকে কাজে লাগিয়ে ঘোষণা করে যে,আমার মন্ত্রপূত কোনও কাগজই আগুনে সম্পূর্ণ পুড়বে না। দেখা যাবে বহু মানুষই ওই ধর্মগুরুর কথাকেই মেনে নেবেন,প্রকৃতির কার্যকারণের বিষয় ভেবে দেখবেন না। মানুষের নাভিকুন্ড না পোড়ার ব্যাপারটাও অনেকটা এই রকমের।
নাভিকুন্ডের মধ্যে একটা অতি অলৌকিক কিছু একটা ব্যাপার আছে,এই ধারণাটা যদি নষ্ট হয়ে যায়, তবে এটাকে ঘিরে যে লৌকিক আচার কিম্বা সংস্কার আছে, সেগুলোও একেবারে নির্মূল হয়ে যাবে। তাই এই ধরনের ভ্রান্ত ধারণাকে নষ্ট করে দেওয়ার প্রচেষ্টা আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় থাকে না। রাষ্ট্র ও সরকারও এসব ব্যাপারে মাথা ঘামায় না। কারণ, তাহলে বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে। আর আমরা সাধারণ মানুষেরাও এই নিয়ে খুব একটা চিন্তা করতেও রাজী হই না। তাই এই রকম বহু ভ্রান্ত ধারণা আমাদের মনের মধ্যে বাসা বেঁধে আছে। থাকবেও বহু কাল।
বিয়ে করা কি উচিৎ না কি ভুল হবে?
অনুবাদক- নির্মাল্য দাশগুপ্ত
এমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেব ভাবছি। আশা করি, এমার তরফেও আপত্তি নেই। কিন্তু বিয়েটা কি করা ঠিক হবে? করলেও এখনই কি করব না কি পরে? ভাবছেন বিয়ে করা নিয়ে কার এত ভয়, কার এত সংশয়, এত ধন্ধ? কার 'জয় করে তবু ভয় কেন যায়না'? আর কারো নয়, বিবর্তনবাদের জনক স্বয়ং চার্লস ডারুউইনের। যদিও ১৮৩৮ সালের 11 নভেম্বর ডারউইন তাঁর তুতো বোন এমা ওয়েডউডকে বিয়ের প্রস্তাব দেন এবং এমা সম্মতি জানান। পরের বছর ২৯ জানুয়ারি তাঁদের বিয়ে হয়। ডারউইন তাঁর বাগদানে পর্বের আগে এই দুটি নোটে বিয়ের উপকার ও অপকার নিয়ে নিজের সাথে প্রবল যুদ্ধ করেছেন, এবং শেষ পর্যন্ত বিয়ে করাই ঠিক বলে মনে করেছেন। এরকম একজন মনীষী ও অবিস্মরণীয় প্রতিভারও সাধারণের মত বিবাহ নিয়ে সংশয় বেশ কৌতুক উদ্রেককারী।
প্রথম নোটঃ ১৮৩৮ ৭ এপ্রিলের পরের কোন সময়
যদি বিয়ে না করি- তবে ঘুরে বেড়াতে পারব। ইউরোপ? আমেরিকা ???? ভূতত্ত্বের যাদুঘর অ্যামেরিকায় যাবই। মেক্সিকো যাওয়াটা অবিশ্যি শরীর-স্বাস্থ্য, ক্ষমতা আর প্রাণিবিদ্যায় কতটা পটু হতে পারি, তা দেখে পরে না হয় ভাবা যাবে। আর ভ্রমণ না করলেও, বিভিন্ন প্রজাতি উদ্ভব, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীব নিয়ে কাজ করা যেতে পারে। ভূতত্ত্ব নিয়েও কাজ করা যেতে পারে। কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষাও করা যেতে পারে।
প্ল্যান বি- লন্ডনে রিজেন্টস পার্কের কাছে ছোট্ট একটা ঘরে থাকব। ঘোড়া থাকবে। গ্রীষ্মে ঘুরেঘুরে প্রাণিবিদ্যা আর ভূতত্ত্বিক নমুনা সংগ্রহ করব।
কিন্তু বিয়ে করলে, বাঁধা মাইনের জন্য চাকরি করে যেতেই হবে। লন্ডনের একঘেয়ে জীবন, খালি সামাজিকতা আর সামাজিকতা। দেশ বেড়াতে পারবনা, প্রাণিবিদ্যার নমুনা সংগ্রহ করতে পারব না, বই কেনা হবেনা। ওই কোনক্রমে কেম্ব্রিজে ভূতত্ত্ব বা প্রাণিবিদ্যার প্রফেসারি করেই জীবন কাটাতে হবে। আর এসবগুলো যদি করতেই হয়, সেক্ষেত্রে প্রাণিবিদ্যার গবেষণা সুষ্ঠু ভাবে করতেই পারবনা। দেশের মধ্যে এরকম শীতঘুমে জীবন কাটাবার চেয়ে আর একটু ভাল কি কিছু করা যায়না? লন্ডনের কাছাকাছি কোন গ্রামে বেশ রাজকীয় একটা বাড়িতে থাকা যেতে পারে অবশ্য। কিন্তু কিস্যু না করে, ঐ রকম কুঁড়েমি করে তো জীবন কাটানো আমার পক্ষে অসম্ভব। নাকি, তার চেয়ে লন্ডনেই বন্দিদশা কি মেনে নেব? যদি মোটামুটি টাকা পয়সা করতে পারি, তাহলে লন্ডনে বড়সড় একটা বাড়িতে থাকা যাবে। কিন্তু প্ল্যান বি অনুসারে পয়সা কড়ি হাতে না থাকলে কাচ্চা বাচ্চা নিয়ে কি সেরকম বাড়িতে থাকা যাবে না। সেক্ষেত্রে লন্ডনের কাছের কোন গ্রামই ভাল।কিন্তু গ্রামে থাকা রোজগার আর বিজ্ঞানচর্চার পক্ষে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। কেম্ব্রিজে থাকা ভাল এক্ষেত্রে, তবে হাতে পয়সা না থাকলে আর প্রফেসারি না করলে, সেখানে আবার অবস্থাটা দাঁড়াবে ঢাঙায় তোলা মাছের মত। নাঃ, কেম্ব্রিজের প্রফেসারিটাই সবচেয়ে ভাল এক্ষেত্রে। এটা করেই যা করার করতে হবে। ঘড়ি ধরে কাজ করব, আর যেটুকু সময় বাঁচবে গবেষণার কাজ করব। যা বুঝতে পারছি, হয় কেম্ব্রিজের প্রফেসার অথবা দারিদ্র এই আমার কপালের লিখন। তবে হ্যাঁ, লন্ডনের উপকণ্ঠে ছোট্ট একটা ঘরে গরীব হয়ে কাটালেও কাজের ক্ষেত্রে কিন্তু আমার স্বাধীনতা থাকছে।
সরাসরি পর্য্যবেক্ষণের মত আনন্দ আমি অন্য কিছুতেই পাইনা, সেক্ষেত্রে লাইলের (বন্ধু) মত সেই পুরনো ট্রেনে নতুন তথ্য জোড়া আর ভুল শোধরানো কি আমার কিছুতেই ভাল লাগতে পারেনা। লন্ডনে থাকার বাধ্যবাধকতা থাকলে একজন কি ভাবে এগোতে পারে, সেই পথটাই তো দেখতে পাচ্ছিনা ঠিকঠাক। এদিকে গ্রামে থাকলে থাকবে, নিম্নস্তরের প্রাণীদের ওপর নানা পর্য্যবেক্ষণ আর পরীক্ষা নীরিক্ষার সুযোগ আর সময়।
দ্বিতীয় নোট, জুলাই ১৮৩৮
প্রশ্ন সেই একই- বিয়েটা কি করব?
বিয়ে করলে ঈশ্বর কৃপায় বাচ্চারা থাকবে – চিরকালের সঙ্গী আর বৃদ্ধ বয়সের এমন বন্ধু পাব – যার একজনের প্রতিই টান থাকবে – ভালবাসার ও খেলার সঙ্গী পাব — অন্তত কুকুরের চেয়ে তো ভাল। বাড়ি হবে। তার দেখভাল করার একজন লোক হবে। গান বাজনা হবে এবং বৌয়ের সাথে গল্প করা যাবে। এসব একজনের স্বাস্থ্যের পক্ষে খুবই ভাল। কিন্তু মারাত্মক সময়ের অপচয়।
হে ভগবান, ভাবা যাচ্ছেনা, যে একজন খালি শ্রমিক মৌমাছির মত সারাটা জীবন খালি কাজ আর কাজ করে অপচয় করবে, আর কিস্যু হবেনা তারপর। না, না , কেউ পারবেনা এরকম। ভাবতে পারা যায়, একজনকে সারাজীবন লন্ডনে ধোঁয়া ভর্তি একটা নোংরা ঘরে একাকী একা কাটিয়ে দিতে হবে। অন্যদিকের ছবিতে দেখতে পাচ্ছি- একটু আগুনের উষ্ণতা, সোফায় বসে থাকা সুন্দরী নরম সরম স্ত্রী, কিছু বই আর গান বাজনা- এর উল্টোদিকে গ্রেট মার্লব্রো স্ট্রিটের ঘোলাটে বাস্তবতার কথা ভাবলেই-
না , না, না, বিয়ে করব, করব, করব- নান্য পন্থা
কিন্তু বিয়ে না করলে- যেখানে খুশি যাবার স্বাধীনতা- সমাজিকতার বালাই থাকবেনা- ক্লাবে বুদ্ধিমান লোকেদের সাথে আড্ডা দেওয়া যাবে- আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি যেতে কেউ জোর জবরদস্তি করবে না- ছোটখাট অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে পড়ে থাকতে হবেনা - বাচ্চাদের পেছনে খরচ আর উৎকণ্ঠা থাকবেনা- বৌয়ের সাথে ঝগড়া করে সময় নষ্ট হবেনা- সন্ধে বেলা নিজের মত পড়াশুনো নিয়ে থাকা যাবে- চর্বি বাড়বেনা বসে বসে- উৎকণ্ঠা আর দায়িত্ব থেকে মুক্তি- তার মধ্যে এক গাদা বাচ্চা কাচ্চা হলে প্রতিটার খোরাকি জোগাড় করতেই সময় চলে যাবে- একজনের পক্ষে এত পরিশ্রম স্বাস্থ্যের পক্ষে খুবই খারাপ। হয়তো বৌয়ের লন্ডন ভালই লাগল না। তারপরের কথাই হল নির্বাসন, আর একজন নিষ্কর্মা মূর্খে পরিণত হওয়া।
তবুও বিয়েটা করা দরকার। কিন্তু কখন? এখনি না পরে?
মহাজনে বলে বিয়ে তাড়াতাড়ি সেরে ফেলা উচিৎ। কম বয়সে লোকের চিন্তা ভাবনা অনেক নমনীয় থাকে, অনুভূতি তীব্র থাকে, তাই সে সময় তাড়াতাড়ি বিয়ে না সারলে, সেই অনাবিল আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করা হবে।
কিন্তু যদি কালকেই বিয়ে করি, সেক্ষেত্রে আমায় একটা সাজানো গোছানো ভদ্রস্থ বাড়ি পেতে একগাদা টাকা আর অনন্ত ঝামেলা পোয়াতে হবে - সামাজিকতা রক্ষার জন্য নিত্য অশান্তি- সকাল সকাল হাঁকডাক- বিশ্রী সব ব্যাপার স্যাপার- প্রতিদিন সময়ের অপচয়। (বৌ ছাড়া জীবনটা দেবদূতের মত ফুরফুরে আর পরিশ্রমী করে তোলে)। আমি আমার সব কাজকম্ম করব কিভাবে যদি বৌয়ের সাথে রোজ আমার হাঁটতে বেরোতে হয়? ধুস্!! আমি কোনদিন ফরাসীরা কেমন জানতেই পারবনা, এই মহাদেশ দেখতে পাবনা, অ্যামেরিকা যাওয়া পণ্ড- বেলুনে চড়ার বা বেশ একা একা জাহজে করে ওয়েলস যাওয়া বাতিল- ক্রীতদাসের জীবন মাইরি- বা তাদের চেয়েও খারাপ হয়তো- তার ওপর তীব্র দারিদ্র- (বৌ না থাকলে কিন্তু জীবনটা দেবদূতের মত ফুরফুরে সাথে প্রচুর টাকা)। নাঃ, বালক, এসব ভাবনা ছাড়- উত্তিষ্ঠত জাগ্রত- এভাবে নিঃসঙ্গ একাকী জীবন কেউ কাটাতে পারেনা, বিশেষত বৃদ্ধ হয়ে অসুস্থ অবস্থায়, বন্ধুহীন জীবন, ঠাণ্ডা, নিঃসন্তান অবস্থায় পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা, যে মুখে এখনি বয়েস থাবা বসাতে শুরু করেছে। বাদ দাও এসব আজেবাজে ভাবনা, একটা সুযোগ দাও নিজেকে- চাদ্দিকে তাকিয়ে দেখ- অনেক সুখী ক্রীতদাসও দুনিয়ায় চড়ে বেড়াচ্ছে
মূল পাণ্ডুলিপিগুলি ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের ডারউইন আর্কাইভে রয়েছে- DAR 210.8:2
অনুবাদকের কৈফিয়ত- ডারউইনের নোটদুটি ভাঙা ভাঙা বাক্যে, কখনো একটি দুটি শব্দে নিজের জন্য লেখা- সেভাবে লিখলে পড়ার সুখ থাকবেনা, তাই একদম আক্ষরিক অনুবাদ না করে, কিছু ক্রিয়াপদ বিশেষণ ইত্যাদি জুড়তে হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে ঠিক কি বলতে চেয়েছেন একটা দুটো শব্দে, সেটা বোঝাও একটু কঠিন হয়ে গিয়েছিল। আশা করি, যথাযথ বুঝে সেটা সঠিক ভাবে ভাবটা তুলে ধরতে পেরেছি। যদি কিছু ভুল পান, জানাবেন অবশ্যই।
কলকাতার জলাভূমি এবং এক পরিবেশবিদ।
-সৌরদীপ চ্যাটার্জী
আপাতত টিভি আর খবরের কাগজ খুললেই দেখা যাচ্ছে, বন্যায় ভেসে যাচ্ছে দক্ষিণবঙ্গ। দামোদর, অজয়, দ্বারকেশ্বর, রূপনারায়ণ—রাঢ়বঙ্গের আপাত নিরীহ নদীগুলি রীতিমত ফুঁসছে! কলকাতায় কিছুদিন আগে অবধি বিভিন্ন জায়গায় জল জমে ছিল, সেই জল থেকে তড়িদাহত হয়ে দু’টি শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটল। সবাই দেখছেন, হইহই করছেন, ফেসবুকে ‘দুয়ারে দীঘা’, ‘লন্ডন বানাতে গিয়ে ভেনিস’ ইত্যাদি ক্যাপশন জুড়ে দিচ্ছেন। কিছুদিন আগে আনন্দবাজারের ভেতরের পাতায় একটা ছোট্ট খবর বেরিয়েছিল। “বেআইনি দখলদারির চোটে আন্তর্জাতিক মর্যাদা হারানোর আশঙ্কা পূর্ব কলকাতা জলাভূমির”। কেউ দেখেছিলেন এবং সেই নিয়ে হইচই করেছিলেন বলে মনে পড়ে না।
এইভাবেই সামনে আসে ফলাফল, পেছনে থেকে যায় কারণগুলো।
জলাভূমিতে ভৌতিক রহস্য বা আলেয়ার গল্প আমরা ছোটবেলায় অনেক শুনেছি! কিন্তু গোটা জলাভূমিটাই যদি হয়ে ওঠে এক রহস্য? এরকমই এক রহস্যময় জলাভূমি হল ‘পূর্ব কলকাতা জলাভূমি’। যারা নলবন বা নুনের ভেড়িতে শীতকালে সামান্য উষ্ণতার খোঁজে পিকনিক করতে যান, তারা হয়ত জানেনই না, জায়গাটা একটি আন্তর্জাতিকভাবে সংরক্ষিত ‘সাইট’; শুধু তাই নয়—বাংলা বা ভারতে নয়, সারা পৃথিবীরই একটি বিরল বিস্ময়! খুব সামান্য কয়েকজন হয়ত নামটা জানেন—‘রামসার সাইট!’ জলাভূমি সংরক্ষণ নিয়ে পৃথিবীর অন্যতম শীর্ষ আন্তর্জাতিক চুক্তি। ইরানের একেবারে উত্তরে, কাস্পিয়ান সাগরের তীরে পাহাড়ে ঘেরা রুক্ষ ছোট্ট শহর রামসার, হাজার তিরিশ মত লোকের বসবাস। ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে এখানেই বসেছিল জলাভূমি নিয়ে এক আন্তর্জাতিক বৈঠক। তখনও ইরান শাহের অধীনে। ইরান সরকার বৈঠকের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, প্রাথমিকভাবে ঠিক ছিল বৈঠক হবে কাস্পিয়ান সাগরের তীরে অন্য এক শহরে—নাম বাবোলসার। কিন্তু ১৯৭০ সালের এপ্রিল মাসে সিদ্ধান্ত বদলে বৈঠক সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ১৭৫ কিলোমিটার পশ্চিমে, রামসারে। মাত্র ১৮ টি দেশ প্রতিনিধি পাঠিয়েছিল, আশ্চর্যজনকভাবে, তাতে ছিল ভারতও। তখন রামসারে এয়ারপোর্টও ছিল না। তেহরানে সবাই জমায়েত হলেন, তারপর গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হল প্রায় আড়াইশো কিলোমিটার দূরে। সম্মেলন শুরু করলেন খোদ ইরানের রাজপুত্র, আবদুল রেজা পহলভী। ৩ ফেব্রুয়ারি সেই সম্মেলনে একটি আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার স্বাক্ষরিত হল—যে শহরের নামও কেউ জানত না, সেই শহরের নামে তার নাম হয়ে গেল ‘রামসার কনভেনশন অফ ওয়েটল্যান্ডস’। বর্তমানে এর সদস্যসংখ্যা ১৭১, সদর দফতর সুইজারল্যান্ডে।
বর্তমান ভারতে রামসার সাইটের সংখ্যা চল্লিশের বেশি। তালিকায় আছে চিলিকা হ্রদ, মণিপুরের লোকটাক হ্রদ, কোল্লেরু হ্রদ, লোনার ক্রেটার, ভিতরকণিকা, কাশ্মীরের উলার হ্রদ। পশ্চিমবঙ্গ থেকে আছে দু’টি। দ্বিতীয়টি আয়তনে ভারতের বৃহত্তম রামসার সাইট—সুন্দরবন। সুন্দরবন বহুল আলোচিত, চর্চিত এবং দর্শিতও। সারা বছর দেদার লোক বেড়াতে যান, পাঠ্যবইতে বাচ্চারাও পড়ে সুন্দরবনের গুরুত্ব। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের প্রথম রামসার সাইটটি আমাদের চোখের সামনেই যেন অদৃশ্য হয়ে রয়েছে।
অদৃশ্যই বটে। কারণ আজ থেকে মাত্র তিরিশ বছর আগেও পুরোটাই ছিল রহস্যে ঘেরা। কীরকম রহস্য? প্রকৃতির এক বিচিত্র রহস্য! ভৌগলিকভাবে কলকাতা ভারতের অন্যতম নিচু শহর। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাপলে চার-পাঁচ মিটারও হবে কিনা সন্দেহ! কলকাতার পশ্চিমে গঙ্গা, অথচ শহরের ঢাল পুবে। প্রতিদিন শহরে প্রায় সাতশো মিলিয়ন লিটার তরল বর্জ্য উৎপন্ন হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন বড় বড় শহরে এই পরিমাণ বর্জ্যকে সাফাই করার জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করে নিকাশি প্ল্যান্ট তৈরি করা হয়। কলকাতায় এমন একটিও ‘প্ল্যান্ট’ নেই। ছিলও না কোনোকালে। শহরও অত্যন্ত নিচু অববাহিকায়। তারপরেও, নোংরা জলে সেরকম বিশাল মাপের দূষণের কোনও খবর আসে না। তাহলে ওই অতখানি নোংরা জল যায় কোথায়?
ওপরের পুরো প্রশ্নটা আসলে বর্তমানকালের নয়, হবে অতীতের হিসেবে। সময়টা আশির দশক। প্রশ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছিল একজন সরকারি অফিসারের মাথায়। তিনি ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ। পেশায় রাজ্য সরকারের ইঞ্জিনিয়ার, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র—ইঞ্জিনিয়ারিং-এর পাশাপাশি রীতিমত ইকোলজি বা বাস্তুবিদ্যায় পিএইচডি। রাজ্যে তখন সদ্য এসেছে বামফ্রন্ট সরকার। তাদেরই নির্দেশে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে নেমে পড়েছিলেন ধ্রুবজ্যোতিবাবু। চারিদিকে অনুসন্ধান চালালেন। নিকাশি প্ল্যান্টের কার্যপদ্ধতি বুঝতে মুম্বইয়ের ‘দাদার সিউয়েজ প্ল্যান্ট’ ঘুরে দেখে এলেন। কিন্তু কোথাও কিছুই জানা গেল না। কলকাতার বর্জ্য জলের নিকাশি কোথায়, কলকাতার কেউ জানে না। সেই জল কোথায় যায়—তাও কেউ জানে না। অন্যান্য শহরে যে জলের নিকাশিতে কোটি কোটি টাকা খরচ হয়, কলকাতায় যেন সেই জল ম্যাজিকের মত ‘ভ্যানিশ’ হয়ে যায়। শেষে একদিন তিনি নেহাতই ঘটনাচক্রে নিকাশি নালা আর খাল ধরে এগনো শুরু করলেন। দেখতে চান, নালাগুলো যায় কোথায়! এই উত্তর খুঁজতে গিয়েই ধ্রুবজ্যোতিবাবু হাজির হলেন কলকাতার পুবপ্রান্তের এই জলাভূমিতে। আপাতভাবে দেখলে মনে হয় জলাজমি—আমাদের ভাষায়, ‘নুনের ভেড়ি’—কোনো কাজে আসে না। তখন ওইসব এলাকা একেবারেই অনুন্নত, সামান্য রাস্তাঘাটও নেই। কিন্তু সেখানেই ধ্রুবজ্যোতিবাবু পরীক্ষানিরীক্ষা চালানো শুরু করলেন। ফলাফল দেখে রীতিমত ‘চক্ষু চড়কগাছ’ অবস্থা। দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ধ্রুবজ্যোতিবাবু জলের মতই সহজ করে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। “বর্জ্যজল আসলে কিছুই না, ৯৫% জল এবং ৫% জীবাণু। এই বিশাল জলাভূমিতে ওই বর্জ্যজলের জীবাণু জলজ বাস্তুতন্ত্রে শৈবাল ও মাছের খাদ্যে পরিণত হয়। ফলে স্রেফ প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রেই সূর্যালোকের অতিবেগুনি রশ্মির সাহায্যে ও সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ায় পুরো জল পরিশুদ্ধ অবস্থায় চলে আসে, বিপুল মাছের ভাণ্ডার তৈরি করে—পুরোটাই সম্পূর্ণ বিনামূল্যে—বিন্দুমাত্রও শোধন করাতে হয় না!”
প্রায় একার চেষ্টায় ধ্রুবজ্যোতিবাবু কলম্বাসের মত নতুন করে আবিষ্কার করেছিলেন শহরের পুবপ্রান্তের এই বিশাল জলাভূমিকে। যদিও ব্যাপারটা বিশ্বাস করাতে বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল তাঁকে। ততদিনে সেই অগভীর জলাভূমির বেশ খানিকটা ভরাট করে সল্টলেক তৈরি হয়ে গিয়েছে। তৎকালীন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন। তবে জলাভূমির গুরুত্বটা তিনিও বুঝতে পারেননি। তবু গঙ্গা থেকে পলি তুলে সেই লবণ হ্রদের প্রায় অর্ধেকটা ভরাট হয়েছিল, বাকিটা ডাক্তার রায় ছেড়ে রেখে দেন। ডাচ সংস্থা নেডেকো ও একদল যুগোস্লাভ ইঞ্জিনিয়ার দুর্দান্ত পরিকল্পনা করে নগর ‘ডিজাইন’ করেছিলেন। ১৯৭২ সালে জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশন বসেছিল সল্টলেকে, সভাপতি ছিলেন ভাবী রাষ্ট্রপতি শঙ্করদয়াল শর্মা। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর থাকার জন্য তৈরি হয়েছিল ছোট্ট একটি বাংলো, নাম দেওয়া হয় ‘ইন্দিরা ভবন’। কিন্তু সেই ইন্দিরা ভবনের পরবর্তী বাসিন্দা—মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু—ক্ষমতায় আসতেই গোলমাল শুরু হয়। ডাঃ রায় ইউরোপের ইঞ্জিনিয়ারদের দিয়ে এলাকা পরীক্ষা করিয়েছিলেন, কিন্তু বিলেত-ফেরত জ্যোতিবাবুর অত ধৈর্য ছিল না। ফলে সল্টলেকের আকার বাড়তে শুরু করল, শুরু হয় অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণ। তখন জোর যার মুলুক তার। প্রোমোটারি শক্তি পাখনা মেলছে। ১৯৯০ সাল নাগাদ জ্যোতিবাবুর সরকার ঘোষণা করেন—ওই জলাভূমি বুজিয়ে একটা বিশাল বড় বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপন করা হবে। রাজ্য সরকারের কর্মী ধ্রুবজ্যোতিবাবু চাইলেও তার বিরোধিতা করতে পারবেন না। অতএব তাঁর পরামর্শে হাইকোর্টে মামলা করল একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা 'PUBLIC' (People United for Better Living in Calcutta)। ১৯৯২ সালে দেশের অন্যতম প্রথম পরিবেশবান্ধব রায়টি দিয়েছিল কলকাতা হাইকোর্ট—বিচারপতিরা ঘোষণা করলেন, ওই জলাভূমি বোজানো চলবে না, তাকে সংরক্ষণ করতে হবে।
ততদিনে জলাভূমি সংরক্ষণেই মনপ্রাণ সঁপে দিয়েছেন ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ। সরকারকে বোঝানোর বহু চেষ্টা করেছিলেন। সটান মুখ্যমন্ত্রীর কাছে গিয়ে দরবার শুরু করেন তিনি। একদিন মুখ্যমন্ত্রীকেই তিনি নিয়ে যান সেখানে। তারপর জলের গুরুত্ব ও প্রাকৃতিক বিশুদ্ধতা বোঝাতে মুখ্যমন্ত্রীর সামনেই সেই তথাকথিত ভেড়ি বা নোংরা জলাভূমি থেকে এক গ্লাস জল তুলে ঢকঢক করে খেয়ে নেন। হাঁ হাঁ করে ওঠেন মুখ্যমন্ত্রী। আশেপাশে যাওয়ার মত কোনও পায়খানাও নেই। পেটখারাপ অনিবার্য। কিন্তু কিছুই হল না। ধ্রুবজ্যোতিবাবু দেখিয়ে দেন, ওই জল খেলেও কিছুই হবে না। ওই জল প্রাকৃতিকভাবে পরিশুদ্ধ।
সম্ভবত—ওই জলাভূমি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক জলশোধক!
লেখালেখি করতে ভালবাসতেন ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ। শুরু করেন পূর্ব কলকাতার জলাভূমি নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে লেখালেখি। তাঁরই প্রায় একক চেষ্টায় খবর পৌঁছয় সুইজারল্যান্ডে, আন্তর্জাতিক জলাভূমি সংরক্ষণ সংস্থার দফতরে। আসেন বিদেশী বিশেষজ্ঞরা। অবাক হয়ে গিয়েছিলেন সকলেই। কারণ এরকম প্রাকৃতিক শোধন ভারত কেন, গোটা দুনিয়াতেও দ্বিতীয়টি নেই। নিজেদের জ্ঞাতে বা অজান্তেই ইংরেজরা এমন একটি জায়গাকে নিজেদের উপনিবেশের রাজধানী বানাতে বেছে নিয়েছিল, যার একদিকে গঙ্গার প্রবাহ, অন্যদিকে প্রাকৃতিক জলাভূমি। কলকাতা ময়দান যদি কলকাতার ফুসফুস হয়, তাহলে এই জলাভূমিই হবে তার কিডনি। অবশেষে ২০০২ সালে এল সেই সুখবর। পশ্চিমবঙ্গের প্রথম ‘রামসার সাইট’ হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হল এই পূর্ব কলকাতা জলাভূমি।
স্বীকৃতি এলেও ধ্বংসলীলা থামেনি, চলেছে বছরের পর বছর ধরে। প্রায় তিরিশ হাজার মানুষের জীবিকা সরাসরিভাবে জড়িত এই জলাভূমির সঙ্গে। আজও আমরা জানিই না, রোজ গরম গরম ভাতের সঙ্গে পাতে যে মাছের ঝোল বা ঝাল খাই, তার বেশিরভাগটাই আসে আসলে এই ভেড়ি থেকে। পাশাপাশি, বিপুল পরিমাণ শাকসবজির জোগান দেয় এই এলাকা। স্রেফ এই কারণেই ভারতের সমস্ত মহানগরের মধ্যে বাজার খরচের ব্যাপারে সবচেয়ে সস্তা আমাদের কলকাতা। পাশাপাশি, বিপুল পরিমাণ অক্সিজেনের জোগানও দেয় এই জলাভূমি। কার্যত একটি পয়সাও খরচ না করে দূষিত জল নিয়ে সে ফেরত দেয় টাটকা জল, মাছ, শাকসবজি, অক্সিজেন।
এবং এর সবচেয়ে রহস্যময় ভূমিকা হল বন্যা নিয়ন্ত্রণ। যে বিপুল পরিমাণ জলে প্রতিদিন ভেসে যেতে পারত কলকাতা, তার বেশিরভাগটাই টেনে নেয় এই জলাভূমি, তারপর অবশিষ্ট চলে যায় বিদ্যাধরী নদীতে। তাই অন্তত বছর দশেক আগে অবধি মুম্বই বা চেন্নাই নিয়মিত বন্যায় ভেসে গেলেও দিব্যি টিকে যেত কলকাতা।
আজ ভেঙে পড়েছে পুরো ব্যবস্থাটাই। চলছে যথেচ্ছ প্রোমোটিং, জলাভূমি ভরাট, নগরায়ণ। চলছে দূষণ। ফলে নজিরবিহীন সংকটের মুখে পূর্ব কলকাতার এই জলাভূমি। প্রকৃতি সামান্য রুষ্ট হলেই আজ ভেসে যাচ্ছে কলকাতা। জমা জলে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে, জলবাহিত ও মশাবাহিত রোগ বাড়ছে। অজানা জ্বরে হাসপাতাল উপচে পড়ছে। ড্রেনগুলো অবরুদ্ধ। জলে তড়িদাহত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। রোজকার সান্ধ্য আড্ডায় উঠে আসে অনেক ভারি ভারি প্রসঙ্গ—লকগেট কখন খুলবে, কর্পোরেশন পাম্প চালাচ্ছে না কেন ইত্যাদি। অথচ এইগুলোর কোনোটাই যে স্থায়ী সমাধান নয়, তা আমজনতা বুঝতে চান না, রাজনীতিবিদরা বুঝতে দেন না। কারণ বুঝতে দিলে তাঁদের বিপদ। রাজনীতির নেতাদের ব্যবসাটাই দাঁড়িয়ে আছে এই জলাভূমি ভরাটের ওপর। পূর্বতন বাম জমানায় যা ছিল, বর্তমান ঘাসফুল জমানায় তা তেড়েফুঁড়ে বেড়েছে। সরকারের হেলদোল নেই। সম্ভবত সরকার যারা চালান, তাঁদের এতটা গভীরে গিয়ে ভাবার মতও বিদ্যে নেই। বা বলা ভাল, ভাবার দরকারও নেই। এই পাম্প করে জল বের করা বা রাস্তা খুঁড়ে বছরের পর বছর পাইপ বসিয়ে চলা বা লকগেটের ওপর নির্ভর করা—এগুলি সবই আসলে ‘ডায়ালিসিস’ পদ্ধতি। যে পদ্ধতিতে কৃত্রিমভাবে রক্ত পরিশোধন করে কিডনির কাজ চালানো হয়। সকলের অলক্ষ্যে ক্রমশ পাঁক জমে, দূষিত ও বিষাক্ত রাসায়নিক জমে ও ভরাট হয়ে বিকল হয়ে পড়ছে কলকাতার আসল সেই ‘কিডনি’—এই জলাভূমি।
জলাভূমি নিয়ে আন্দোলন আমৃত্যু চালিয়ে গিয়েছেন ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ। একাধিক বই লিখেছেন, তার মধ্যে ‘ইকোলজি অ্যান্ড ট্র্যাডিশনাল ওয়েটল্যান্ড প্র্যাকটিস’ বইটি কার্যত এই বিষয়ের ‘ইউজার ম্যানুয়াল’ হতে পারে। বইটি সম্ভবত আজ আর পাওয়া যায় না। অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে জলাভূমি বা ‘ওয়েটল্যান্ড’-এর সংজ্ঞা, ব্যবহার, বিস্তার, প্রায়োগিক দিক ইত্যাদি সবই ব্যাখ্যা করেছিলেন তিনি। ২০০৫ সালে প্রকাশিত এই বইটিতে মুখবন্ধ লিখে দিয়েছিলেন ভারতের এক প্রখ্যাত কৃষিবিজ্ঞানী। লিখেছিলেন—“...অমর্ত্য সেনের ‘ওয়েলফেয়ার ইকনমিক্স’-এর মতই ধ্রুবজ্যোতি ঘোষের এই আন্দোলনের নাম দেওয়া যেতে পারে ‘ওয়েলফেয়ার ইকোলজি’...”। লেখক—ভারতীয় সবুজ বিপ্লবের জনক প্রোফেসর এম এস স্বামীনাথন।
দূর্ভাগ্য যে, তাঁর কথা অমান্য করার ফল কী হতে পারে, তা বহু আন্তর্জাতিক সম্মানে সম্মানিত ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ আর দেখে যেতে পারলেন না। ২০১৮ সালেই তিনি বিস্মৃতলোকে গমন করেন।
সাম্প্রদায়িকতার বিষ
-শীলা মোস্তাফা
কবি রুদ্র মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ বলেছিলেন “জাতির পতাকা খামচে ধরেছে আজ পুরোনো শকুন” আসলে পুরোনো শকুন বলে কিছু নেই। সেই শকুনেরা আমাদের মাঝেই বাস করে। আর সেই শকুনদের দুধকলা দিয়ে পোষেন সরকার। সেই শকুনদের হৃষ্টপুষ্ট রাখতে সরকারী টাকায় মসজিদ তৈরি হয়, তাদের আদর্শের ধারক বাহক তৈরির জন্য হাজার হাজার মাদ্রাসা তৈরি হয় যেখানে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা নেই, নেই জাতীয় সঙ্গীত, নেই ধর্ম নিরপেক্ষতা, নেই অসাম্প্রদায়িক শিক্ষা।
বাংলার মাটিতে বাংলার মুসলমানরা বার বার প্রমাণ করেছে ইসলাম শান্তির ধর্ম নয়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অর্থ বোঝার মত শিক্ষায় শিক্ষিত নয় তারা। এরা যেই শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষিত সেখানে মূলমন্ত্র “জেহাদ” “বিধর্মী” আর তার সাথে সমাধান “বেহেস্ত”। তাদের মগজ এই তিন শব্দের কাছে জিম্মি। তাই পৃথিবীর শান্তি, প্রতিবেশীর শান্তি, রক্তমাংসের মানুষের জীবন তাদের কাছে মূল্যবান নয় । ইসলাম যে অসহনশীল, সাম্প্রদায়িক, জঙ্গির ধর্ম এটা বার বার প্রমাণ হয়েছে। ইসলামে শান্তির সংজ্ঞা হচ্ছে অন্য মত অন্য ধর্মের মানুষকে খুন, ধর্ষণ, হত্যা করা। আগুন দিয়ে জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে মারা।
কোরান ত্রিপিটক, রামায়ণ, বেদ সে তো শুধু পুস্তক। তার অবমাননা হয় না, আকাশ উড়ালেও না, আগুনে পোড়ালে না। অবমাননা হয় তখন যখন ওই পুস্তকে যা লেখা সেটা তার অনুসারী ধার্মিক যদি ধারণ করতে না পারে। তুমি ধর্ম পালন করবে, নামাজ পড়ে কপালে দাগ করে ফেলবে কিন্তু মানুষ নামে রক্তেমাংসে গড়া মানুষকে অবমাননা করবে, তার বেলা…? আর কত চলবে এই অনাচার? আর কত চলবে হিন্দুর বাড়ীতে আগুন দিয়ে দখলদারি, আর কত চলবে পূজার মূর্তি ভাঙ্গা, কত হিন্দু শিশু ধর্ষিত হবে? আর কত চলবে ভয়ভীতি দিয়ে তৈরি করে বাংলাদেশকে বৃহত্তর পাকিস্তানি তালেবানী রাষ্ট্র তৈরি করা?
সরকারের কোন দায় নেই এর পেছনে? উন্নয়ন কি শুধু বড় বড় অট্টালিকা, ব্রিজ, পদ্মা সেতু? শুধু দেশের কাঠামোগত উন্নয়ন হলেই কি দেশের উন্নয়ন হবে? কেন মাদ্রাসাগুলোকে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে আসা হচ্ছে না? কেন সরকারের টাকায় মসজিদ আর মাদ্রাসা তৈরি করে তাতে এইসব জঙ্গি লালন করা হচ্ছে? কেন কোন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হচ্ছে না এই নপুংসকদের? এই সরকারের দরকার ভোট, না না কি বললাম ভোটের তো দরকার নেই। জনগণের জন্য ভাবার কোন দরকার নেই। যাদের দরকার তাদের তো কুক্ষিগত করা আছে, তারা তথাকথিত বুদ্ধিজীবী সমাজ, সংবাদ মাধ্যম, প্রচার মাধ্যম। হেফাজতের হেফাজতকারি সরকারের জন্য জনগণের প্রয়োজন নেই, মৌলবাদের প্রজনন চলুক। এই সরকারের মুখে মুখে “মুক্তিযুদ্ধের চেতনা” অন্তরে “মদিনা সনদ”। এই নিয়ে দেশে আর যাই হোক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশ তৈরি করা যাবে না।
তবুও মানুষ জাগবে
শুনে রাখো
তুমি তোমরা যতবার ধ্বংস করবে
আমরা ততবার সেই আগুন থেকে বেরিয়ে আসব,
যতবার গলা টিপে ধরবে ততবার
তারও অধিক চিৎকার হয়ে ফিরে আসব।
এ মাটিতে ঈদ মহরামের মত শারদীয় দুর্গোৎসব হবে,
বড়দিন পালন হবে, হবে মানবতা জয়গান।
মসজিদে আজান হবে, মন্দিরে ঘণ্টা বাজবে।
যদি অধিকার থাকে ঈদ মহরমের
অধিকার থাকবে পূজা পার্বণ কিংবা
শুধুই মানবতার।
সংকটে নাগরিকত্ব!
-স্বর্ণাভ ভট্টাচার্য
২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে করোনা ও তৎজনিত পরিস্থিতি এবং লকডাউনের জন্য স্বাভাবিক জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে রয়েছে আজও। করোনার খবর ছড়াবার আগে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল "নো এনআরসি মুভমেন্ট" বা এনআরসি বিরোধী আন্দোলন, যা এখনো চলমান। ২০১৯ সালে কেন্দ্রে দ্বিতীয়বার নরেন্দ্র মোদির সরকার গঠনের পর সক্রিয়ভাবে এনআরসি বা জাতীয় নাগরিকপঞ্জী চালু হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তার সাথেই নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল প্রস্তাবিত হয়। একই সালে অসমে সংগঠিত এনআরসিতে প্রায় ১৯ লাখ মানুষের নাম নাগরিক তালিকা থেকে বাদ গেছে। এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন গণ সংগঠন, ছাত্র সমাজ, বুদ্ধিজীবী মহল এনআরসি এবং সিএএ-র বিরোধিতায় রাস্তায় নেমেছেন ; সর্বোপরি প্রতিবাদে সরব হয়েছেন দেশের সাধারণ মানুষ। এত আন্দোলন সত্ত্বেও ২০১৯ এর ১১ই ডিসেম্বরে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল সংসদে পাস হয় এবং ১২ই ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পেয়ে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বা সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট, ২০১৯ -এ পরিণত হয়। ইতিপূর্বেই সরকার ও বিরোধী বিভিন্ন দলগুলো নিজেদের স্বার্থে উক্ত বিষয়ে বিভ্রান্তি ছড়াতে শুরু করেছে, যাতে সমস্যায় পরছেন সাধারণ মানুষ।
এবার স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, এনআরসি কী? সিএএ কী? এবং এর বিরোধিতাই বা কেন করা হচ্ছে? সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ফিরে যেতে হবে অতীতে।
১৯৫০ সালের ২৬ শে জানুয়ারি থেকে দেশে সংবিধান কার্যকরী হয়। এর পর থেকে বারবার সংবিধানের মূল কাঠামো এক রেখে, অন্যান্য বিষয়ে সংযোজন, কাটছাট চলেছে বিভিন্ন আইনের। সেরকমই এক অতি গুরুত্বপূর্ণ আইন, যা দেশের নাগরিকত্বকে সংজ্ঞায়িত করে, সেটাই হলো ১৯৫৫ সালে পাস হওয়া নাগরিকত্ব আইন বা সিটিজেনশিপ অ্যাক্ট, ১৯৫৫ (সিএ ১৯৫৫)। এই আইন অনুসারে, পাঁচ ধরণের মানুষকে ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়ায় অসুবিধা নেই —
১) উক্ত ব্যক্তির জন্ম ভারতে হলে, ২) উক্ত ব্যক্তির বাবা মা দেশের নাগরিক হলে, ৩) নাগরিকত্বের আবেদন করলে, ৪) ন্যাচারালাইজেশন বা স্বাভাবিকীকরণের মাধ্যমে (অর্থাৎ যাঁরা আইনত নাগরিক না হলেও, বহুবছর থাকার ফলে দেশের সংস্কৃতি, রাজনীতি, সমস্ত কিছুর সাথেই মিশে গেছেন), ৫) ইনকরপোরেশন অফ টেরিটরির মাধ্যমে, অর্থাৎ কোনো জায়গা পরবর্তীতে দেশে অন্তর্ভুক্ত হলে, সেই এলাকার প্রত্যেকে ভারতীয় নাগরিক হবে। অতএব, ১৯৫৫ এর নাগরিকত্ব আইন জন্মগত নাগরিকত্বের অধিকার স্বীকার করছে।
পরে বিভিন্ন সরকারের আমলে অন্যান্য আইনের মত সিএ, ১৯৫৫ -এরও সংশোধনী আনা হয়েছে এবং প্রায় প্রত্যেকবারই নাগরিকত্বের অবকাশ হয়েছে সংকীর্ণতর। ১৯৮৬ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনে বলা হয়, ১৯৮৭ সালের ১লা জুলাই পর্যন্ত জন্মসূত্রে ভারতের নাগরিকত্ব পাওয়া যাবে।
পরবর্তী সবচেয়ে আলোচিত ও বিতর্কিত সংশোধনীটি হল ২০০৩ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বা সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট, ২০০৩ (সিএএ ২০০৩)। এখানেই প্রথম নাগরিকত্বের প্রশ্নে এনআরআইসি (ন্যাশনাল রেজিষ্টার অফ ইন্ডিয়ান সিটিজেনস)-র মাধ্যমে ইললিগ্যাল মাইগ্রেন্ট বা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিত এবং তাদের নাগরিকত্ব বাতিলের কথা বলে। বাতিল এই আইনে বলা হয়, ১৯৮৭ সালের ১লা জুলাই থেকে সিএএ ২০০৩ কার্যকর হওয়ার দিন ২০০৪ সালের ৩ রা ডিসেম্বর পর্যন্ত জন্মানো ব্যক্তিকে প্রমাণ করতে হবে তার বাবা বা মায়ের একজন ভারতীয় নাগরিক ও অন্যজন অবৈধ অনুপ্রবেশকারী নন। তাহলেই তিনি ভারতের নাগরিক হিসাবে স্বীকৃত হবেন। স্বভাবতই প্রশ্ন আসে,, যাদের সিঙ্গেল পারেন্ট বা যারা অনাথ আশ্রমে পালিত, তারা কীভাবে নাগরিকত্ব প্রমাণ করবে? তাছাড়াও দেশের এক বিরাট অংশের মানুষ বন্যা, ধস, দুর্যোগ কবলিত উপকূলীয়, পাহাড়, জঙ্গল প্রভৃতি অঞ্চলে বসবাস করেন, যেখানে প্রতিদিন জীবন হাতে নিয়ে বাঁচা, সেখানে নাগরিকত্ব প্রমাণের উপযুক্ত কাগজ কীভাবে তাদের সংগ্রহে থাকবে? যাঁরা উদ্বাস্তু, তাঁরা কাগজ কোথায় পাবেন?
সিএ ১৯৫৫ -এর এই সংশোধনীতে "১৪ক" ধারা যুক্ত করা হয়, যার দ্বারা সরকার দেশজুড়ে এনআরআইসি করার ক্ষমতা পায়। এর মাধ্যমে পূর্বোক্ত প্রমাণের ভিত্তিতে নাগরিকপঞ্জী তৈরি করবে সরকারি আধিকারিকেরা। প্রসঙ্গত, এনআরসি (ন্যাশনাল রেজিষ্টার অফ সিটিজেনস) এবং এনআরআইসি প্রায় একই ব্যাপার। পার্থক্য শুধুমাত্র, এনআরআইসি দেশব্যাপী নাগরিকপঞ্জী তৈরির প্রক্রিয়া ও এনআরসি হল একটি বিশেষ স্থানের নাগরিকপঞ্জীর তৈয়ারী (যেমন, ২০১৯ সালে অসমের ঘটনাটি)।
সিএএ ২০০৩ ছড়ায় সেই সম্বন্ধীয় বিভিন্ন নিয়মাবলী সংকলিত হয় সিটিজেনশিপ (রেজিস্ট্রেশন অফ সিটিজেনস অ্যান্ড ইস্যু অফ ন্যাশনাল আইডেন্টিটি কার্ড) রুলস ২০০৩ -এ। এর ৩ নাম্বার রুলে হলো এনআরআইসি তৈরির নিয়ম রয়েছে। উক্ত রুলের (৪) নাম্বার সাবরুলে বলা হচ্ছে, কেন্দ্রীয় সরকার এই (নাগরিক পঞ্জী) বিষয়ে নির্দিষ্ট তারিখ ঠিক করে তার মধ্যে স্থানীয় রেজিস্টারের এক্তিয়ারে বসবাসকারী ব্যক্তিদের তথ্য সংগ্রহ করে "পপুলেশন রেজিস্টার" তৈরি করতে পারে। উক্ত রুলের (৫) নাম্বার সাবরুলে বলা হচ্ছে, পপুলেশন রেজিস্টারের প্রত্যেক ব্যক্তির তথ্য যাচাই করে "লোকাল রেজিস্টার অফ ইন্ডিয়ান সিটিজেনস" অর্থাৎ স্থানীয় নাগরিক পঞ্জী তৈরি করা হবে। এখানে চলে আসে জাতীয় জনসংখ্যা নিবন্ধন বা ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিষ্টার অথবা সংক্ষেপে এনপিআরের প্রসঙ্গ।
পূর্বে বলা সিটিজেনশিপ রুলস ২০০৩ -এর ৪ নাম্বার রুলের (৩) ও (৪) নাম্বার সাবরুলে বলা হচ্ছে, পপুলেশন রেজিস্টারের প্রত্যেক ব্যক্তির তথ্য স্থানীয় রেজিস্টার দ্বারা যাচাই করা হবে। যাচাইয়ের সময়ে যাদের "সন্দেহজনক নাগরিক" বলে মনে হবে, স্থানীয় রেজিস্টার তাদের বিষয়ে পপুলেশন রেজিস্টারে উল্লেখ করবেন। সেই বিষয়ে তদন্ত করা হবে ও সেই ব্যক্তিকে এব্যাপারে জানানো হবে।
এনপিআরে নথিভুক্ত করা হবে, আধার নাম্বার, বাবা মায়ের তথ্য, তাঁদের জন্মানোর স্থান- কাল জানাতে হবে। সমস্যার বিষয় হলো, "সন্দেহজনক নাগরিক" দাগানো এড়াতে কোন কোন তথ্য দেওয়া আবশ্যিক, তা সিটিজেনশিপ রুলস ২০০৩ -এ উল্লেখ নেই। অতএব, বোঝা যাচ্ছে এই "সন্দেহজনক" তকমার ব্যাপারটি একান্তই রেজিস্টার বা তৎস্থানীয় আধিকারিকের হাতে, যেখানে পক্ষপাতিত্বের সম্ভাবনা পুরো মাত্রায় রয়েছে। আবার এদিকে, আধার কার্ডের সাথে আমাদের বায়োমেট্রিক্স অর্থাৎ আঙ্গুলের ছাপের তথ্য থাকে, যা এনপিআরে সংগ্রহ করা হবে। কেন্দ্রের উদ্যোগে প্যান কার্ড, মোবাইল সিম, ভোটার কার্ড প্রভৃতি সবকিছুর সাথেই আধারের সংযোগ করা হচ্ছে। এর ফলে যে কোনো ব্যক্তি চব্বিশ ঘন্টা রাষ্ট্রের নজরদারিতে থাকবে, তা বলাই বাহুল্য।
জানা যাচ্ছে, এনপিআর ও জনগণনা একই সাথে করার কথা হয়েছে, যা একজন সরকারি আধিকারিক কর্তৃকই সম্পন্ন হবে। অর্থাৎ, অজ্ঞাতসারেই একজন ব্যক্তি তাঁর তথ্য দিতে বাধ্য হবেন।
প্রসঙ্গত এনপিআর কিন্তু নতুন ব্যাপার নয়, সিএ ১৯৫৫ -তেও এর উল্লেখ আছে। যদিও এবারের এনপিআর আসলেই এনআরসির পূর্বধাপ।
উল্লেখ্য, ২০১৯ -এ অসমে ঘটা এনআরসির আগে এনপিআর করা হয়নি। "আসাম পাবলিক ওয়ার্কস" নামের সংস্থার পক্ষ থেকে ২০০৯ সালে আবেদন করা হয় আ অসমে নাগরিক পঞ্জী আপডেট করার, যার ভিত্তিতে ২০১৩ সালে সুপ্রিম কোর্ট তা করতে অর্ডার দেয়। "আসাম অ্যাকর্ড" অনুযায়ী (যা, সিএ ১৯৫৫ -এর ৬ক ধারা হিসাবে যুক্ত করা হয়েছিল), অসমের কাট অফ ডেট ছিল ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ। অর্থাৎ অসমের মানুষদের প্রমাণ করতে হয়েছে, "কাট অফ ডেট" অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চের আগে থেকেই তাঁরা বা তাঁদের পূর্বপুরুষ ভারতের নাগরিক। এক্ষেত্রে নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য প্রয়োজনীয় ১৪টি নথিকে তালিকা ক -তে এবং ৮ টি নথিকে তালিকা খ -তে (যদি তালিকা ক'র নথিগুলি পূর্বপুরুষের হয়ে থাকে, তবে নিজের জন্য এই নথি প্রয়োজন) ভাগ করা হয়েছিল। এতদসত্ত্বেও, অসমে ১৯ লক্ষ মানুষ নাগরিকত্ব হারায়, তাদের মধ্যে ১৪ লক্ষ হিন্দু।
ধারণা করা হচ্ছে, সমগ্র ভারতে যদি এনআরআইসি করা হয়, সেক্ষেত্রে এই কাট অফ ডেট হবে ১৯৪৮ সালের ১৯ শে জুলাই। কারণ, সংবিধানের ৬ নাম্বার ধারায় বলা হচ্ছে, যাঁরা ১৯৪৮ সালের ১৯ শে জুলাইয়ের পরে ভারতে এসেছেন, তাঁদের প্রত্যেককে নাগরিকত্বের আবেদন করতে হবে। আর এর থেকেই পরিষ্কার হয়ে যায়, দেশে নাগরিক পঞ্জী গঠনের কাজে এই তারিখটি গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে।
এবার আসা যাক, সিএএ ২০১৯ প্রসঙ্গে। এই সিএএ ২০০৩ -এর পরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নাগরিকত্ব আইন। কেন্দ্রীয় সরকারের নিজস্ব সংবাদপত্র "দি গেজেট অফ ইন্ডিয়া"তে এই আইনটি প্রকাশ করেছেন ভারত সরকারের সচিব ডাঃ জি. নারায়ণ রাজু। ১০ই জানুয়ারি, ২০২০ তারিখ থেকে এই আইন লাগু হয়েছে।
সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, এই সিএএ আসলে নাগরিকত্ব দেওয়ার আইন, আক্ষরিকভাবে তা সত্যিও। সিএএ ২০১৯ আইনটিতে নাগরিকত্বের আবেদন করার ভিত্তিতে (অতএব এনআরসিতে যারা নাগরিকত্ব হারাবেন, তাদের আবেদনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য) কারা নাগরিকত্ব পাওয়ার যোগ্য হবে, সে বিষয়ক। এই আইনের নব্য সংশোধনীগুলি হলো—
১) এই আইনে সিএ ১৯৫৫-এর ২ নাম্বার ধারার (১) নাম্বার উপধারার (খ) শর্তে যুক্ত করা নিয়মটি হলো —
"আফগানিস্তান, বাংলাদেশ অথবা পাকিস্তানের কোন হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, পার্সি, খ্রিস্টান মানুষ, যারা ৩১ শে ডিসেম্বর ২০১৪ -র আগে ভারতে প্রবেশ করেছেন, এবং যাদেরকে কেন্দ্র সরকার দ্বারা বা পাসপোর্ট (ভারতে প্রবেশ) আইন ১৯২০-র ৩ নাম্বার ধারার (২) উপধারায় (গ) শর্ত অনুযায়ী অথবা বিদেশী আইন ১৯৪৬ (ফরেনার্স অ্যাক্ট ১৯৪৬)-এর নিয়ম প্রযুক্ত করে বা এদের অন্তর্ভুক্ত কোন নিয়ম বা আদেশ জারি করে ছাড় দেওয়া হয়েছে, তাদেরকে এই আইনের আওতায় অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে গণ্য করা হবে না।"
২) এক্ষেত্রে মূল আইন সিএ ১৯৫৫-য় ৬খ ধারার অন্তর্ভুক্তি ঘটে। এতে বলা হয়, অসম, মেঘালয়, মিজোরাম, ত্রিপুরার উপজাতি অঞ্চল এবং বঙ্গীয় পূর্ব সীমান্ত বিধেয়ক ১৮৭৩-এ নির্দেশিত অন্তর্বর্তী সীমা অঞ্চল বাদে দেশের অন্য স্থানে যদি পূর্বোক্ত নাম্বার ধারার (১) নাম্বার উপধারার (খ) শর্তে উল্লিখিত ব্যক্তির নাগরিকত্বের আবেদন কেন্দ্র সরকার বা তাঁর দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক সমস্ত নিয়ম মেনে নথিভুক্তির শংসাপত্র বা স্বাভাবিকীকরণের শংসাপত্র দিতে পারেন। সমস্ত শর্ত মেনে শংসাপত্র পাওয়ার দিন থেকেই সেই ব্যক্তি ভারতের প্রবেশের দিন থেকেই নাগরিক বলে বিবেচিত হবেন এবং এই আইন জারির দিন থেকেই তাঁর বিরুদ্ধে নাগরিকত্ব বা অবৈধ অনুপ্রবেশ বিষয়ক যেকোনো মামলা মকুব হয়ে যাবে। কোনো ব্যক্তি উক্ত ধরণের মামলা চলার কারণে নাগরিকত্বের আবেদন করতে অক্ষম হবেন না এবং আবেদন করলেও (অর্থাৎ নিজের বর্তমান নাগরিকত্বকে অস্বীকার করা) আগের সমস্ত সরকারি সুযোগ সুবিধা তিনি যেমন পেতেন তেমনি পাবেন। উল্লেখ্য, এখানে "অন্তর্বর্তী সীমা"(ইনার লাইন) বলতে বোঝায় ভারত সরকার দ্বারা বিশেষভাবে সুরক্ষিত অঞ্চলগুলিকে, যেসব অঞ্চলে যেতে গেলে যে কোনো সাধারণ ভারতীয় নাগরিকদের "ইনার লাইন পারমিট" নামক বিশেষ অনুমতির প্রয়োজন।
৩) এই আইনের ৭ঘ ধারার সংশোধনী অনুযায়ী, ভারতীয় বংশোদ্ভুত বিদেশী নাগরিক ভারতের কোনো আইন লঙ্ঘন করলে, তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে এই আইন দ্বারা কোনো আদেশ জারি করা যাবে না।
৪) আইনের ১৮ নাম্বার ধারার সংশোধনীতে, এই ধারার (২) নাম্বার উপধারায় (গগ) শর্তের পরে (গগঝ) শর্ত যুক্ত করা হয়। যাতে বলা হচ্ছে, নথিভুক্তির শংসাপত্র বা স্বাভাবিকীকরণের শংসাপত্র দেওয়ার শর্ত, বিধিনিষেধ ও উপায় ৬খ ধারার (১) নাম্বার উপধারা অনুসারে হবে।
৫) শেষত, আইনের তৃতীয় ভাগের (ঘ) শর্তে সংযুক্ত হওয়া নিয়মে বলা হল, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তানের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় অর্থাৎ হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি এবং খ্রিস্টানদের ক্ষেত্রে, উক্ত শর্তের হিসেবে, ভারতের নাগরিকত্বের প্রমাণের জন্য ভারতে বসবাসের বা চাকরির প্রামাণ্য মেয়াদ এগারো বছর থেকে কমিয়ে পাঁচ বছর করা হলো। অর্থাৎ সেই ব্যক্তি পাঁচ বছর (৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ -র আগে থেকে) দেশে রয়েছে বা চাকরির সাথে যুক্ত, তা প্রমাণ করতে হবে।
গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, এনআরসি করার কথা বলা হয়েছে সিএএ ২০০৩ -এ, সিএএ ২০১৯ -এ নয়। সুতরাং, যারা এনআরসি ও সিএএ ২০১৯ -এর বিরোধিতা করছেন, তাদের উচিত সমভাবে সিএএ ২০০৩ -এরও বিরোধিতা, কারণ এনআরসির মূল এই আইনই।
ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, সিএএ ২০১৯ -তে মাত্র ৩১৩১৩ জনই নাগরিকত্বের আবেদন করতে পারবেন। বাকিরা আবেদনও করতে পারবে না। সেই ৩১৩১৩ জনকে হতে হবে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সংখ্যালঘু হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি এবং খ্রিস্টান — এই ৬টি ধর্মের মানুষ, যারা ধর্মীয় নিপীড়নের জন্য এদেশে আসতে বাধ্য হয়েছেন। তারা এদেশে এসে সে বিষয়ে সরকারকে না জানালে, তাদের সিএএ ২০১৯ দ্বারা নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না। যারা তাদের এদেশে আসার কথা জানাবেন, সেই ৩১৩১৩ জনকে "রেজিস্টার্ড রিফিউজি" বলা হচ্ছে। যদিও তাদের প্রত্যেকেই যে নাগরিকত্ব পাবেন, এমনটাও আশা করা যায় না। কারণটা বলি তাহলে।
কারোর এনআরসিতে নাম বাদ যাবার দিন থেকে (অর্থাৎ নাগরিক পঞ্জী প্রকাশিত হওয়ার দিন থেকে, যাতে সেই ব্যক্তির নাম নেই) ১২০ দিনের মধ্যে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে নিজেকে ভারতীয়ত্ব দাবি করতে হবে। এ জন্য তাকে দ্বারস্থ হতে হবে হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টে, যা একজন সাধারণের মানুষের জন্য ভীষণ কষ্টসাধ্য। প্রমাণ স্বরূপ তাকে পূর্বোক্ত ৬টি ধর্মের একটির অনুসারী হতে হবে এবং বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের সংখ্যাগুরু (মুসলিম) দ্বারা নির্যাতিত হয়ে যে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন তাদের ওই দেশের এফআইআরের কপি বা অন্য লিখিত প্রমাণ দেখাতে হবে, যে তাদের ওপর সংখ্যাগুরু দ্বারা অত্যাচার করা হয়েছে। এরপর সেই তথ্যের যাচাই করবে আরএডব্লিউ (র), ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল প্রভৃতি ইন্টেলিজেন্স। তারা নিজেদের কূটনৈতিক চর দ্বারা উক্ত দেশে গিয়ে যাচাই করবে, নাগরিকত্বের আবেদনকারী ব্যক্তির প্রদান করা তথ্য ও ঘটনার উল্লেখ সঠিক কি না! তারপর যদি প্রমাণিত হয় ব্যক্তির তথ্য সঠিক, তবে তিনি নাগরিকত্বের ছাড় পাবেন। অর্থাৎ বোঝাই যাচ্ছে, অত্যন্ত দীর্ঘ এই প্রক্রিয়া।
এতক্ষণ আমরা দেখলাম, নাগরিকত্ব পাওয়ার লড়াইয়ের কথা। স্পষ্টত বোঝা গেল, সিএএ ২০১৯ আইনে সরকার রাজনৈতিক স্বার্থে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের নাগরিকত্বের আবেদনের ব্যাপারটা বিশেষভাবে অনুল্লিখিত থাকলেও, বিপদে পরবেন সমস্ত ধর্মের মানুষ, যে বিষয়ে সতর্ক আমাদের প্রত্যেককেই হতে হবে। শুধু অসমে ১৯ লাখ মানুষের নাম এনআরসি থেকে বাদ গেছে, সেখানে দেশব্যাপী এনআরআইসি হলে অথবা কোনো রাজ্যে/জোনে এনআরসি হলে, কত মানুষের নাম বাদ যাবে তার একটা ধারণা করতেই পারি। আর সেই বিশাল সংখ্যক মানুষের মধ্যে মুসলিম বাদে আবেদনই করতে পারবেন না ৩১৩১৩ জনের বেশি, যাদের আবার প্রত্যেকে নাগরিকত্ব পাবে কি না, যথেষ্ট সংশয়ের।
এবার, আইনের মারপ্যাঁচে যারা বাদ গেলেন বা যাবেন, তাদের ঠাঁই কী হবে? তাদের থাকতে হবে ডিটেনশন সেন্টারে, যতদিন না সেই ব্যক্তিকে কোনো দেশ নিজের অধিবাসী হিসাবে শংসাপত্র দিচ্ছে। আর এই বিশাল সংখ্যক মানুষ দায় কি অন্য দেশ নেবে? শেখ হাসিনা তো পরিষ্কার জানিয়েই দিয়েছেন, বাংলাদেশের কেউ ভারতে প্রবেশ করেনি, অর্থাৎ এত মানুষের দায় তারা নেবেইনা। তাহলে, তাদের কি সারাজীবনের জন্য ডিটেনশন সেন্টারে বন্দী হয়ে থাকতে হবে?
ডিটেনশন সেন্টারের প্রসঙ্গ কেন এলো, তা আলোচনা করা যাক। কোনো নাগরিকত্ব আইনেই বলা নেই, এনআরসিতে বাদ পরা মানুষের, যারা অবৈধ নাগরিক হিসাবে চিহ্নিত হবেন, তাদের পরিণতি কী হবে! তাই ভারতীয় আইনসমূহের অন্য দিকে আমাদের নজর দিতে হবে। তা সেই আইন হচ্ছে, পাসপোর্ট (ভারতে প্রবেশ) আইন, ১৯২০ এবং বিদেশী আইন, ১৯৪৬। পাসপোর্ট (ভারতে প্রবেশ) আইন, ১৯২০ -এর ৫ নাম্বার ধারা অনুযায়ী, ভারতের নাগরিক নয় এমন কোনো ব্যক্তির যদি বৈধ পাসপোর্ট না থাকে, অথবা পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়ে থাকে এবং তা পুনর্নবীকরণ করা না হয়ে থাকে, তবে সেই ব্যক্তি অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসাবে চিহ্নিত করা হবে। বিদেশী আইন, ১৯৪৬ -এর ৩ নাম্বার ধারার (২) উপধারার (ঙ) শর্তে বলছে, দেশে থাকা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসাবে চিহ্নিত ব্যক্তি নির্দিষ্ট স্থানে সরকার আরোপিত সমস্ত বিধিনিষেধ মেনে আটক থাকতে বাধ্য হবে। তার সমস্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার, যেমন পরিচয়, স্বাক্ষর, আঙ্গুলের ছাপ (বায়োমেট্রিক্স), ছবি ইত্যাদি সবকিছুই সরকারকে জানাতে বাধ্য থাকবে। সে সরকার কর্তৃক মেডিকেল পরীক্ষা করাতে বাধ্য হবে। সে সরকার নিষিদ্ধ ব্যক্তি বা কাজ বা জিনিসের সাথে সংশ্রব না রাখতে বাধ্য থাকবে। পক্ষান্তরে, তার সমস্ত গতিবিধির ওপরই নিয়ন্ত্রণ করা হবে। আর এখান থেকেই আসে ডিটেনশন সেন্টারের ধারণা, যা আসলে কিছু সরকারি সুবিধাপ্রাপ্ত বৃহৎ জেলখানা ছাড়া অন্য কিছু না।
যেহেতু, এনআরসিতে বাদ পরা মানুষ নাগরিক বলে গণ্য হবে না, বরং অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর তকমা জুটবে তাদের, তাই তাদের ঠিকানা হবে ডিটেনশন সেন্টার। ২৭ শে নভেম্বর, ২০১৯ তারিখে সরকারের তরফে জানানো হয়, অসমে গোলপাড়া, ডিব্রুগড়, শিলচর, তেজপুর, জোরহাট, কোকরাঝাড় — এই ৬টি জায়গার ডিটেনশন সেন্টারে পাঠানো হয়েছে ১০৪৩ জনকে। কেরালায় তৈরি হচ্ছে ডিটেনশন সেন্টার। আসলে কেন্দ্র যদি এনআরসি তৈরীর নির্দেশ দেয়, যে কোনো রাজ্য সরকারই তা মানতে বাধ্য। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে কোনও রাজ্য কোনো প্রস্তাব নিয়ে এলে, তা হবে অসাংবিধানিক। স্বভাবতই বিভিন্ন রাজ্য ডিটেনশন সেন্টার বানাবার চেষ্টাতেই আছে। ফলে আশঙ্কা তীব্রতর হচ্ছে, এনআরসি চালু হতে দেরি নাই। এত কিছুর মধ্যে সমস্যা হচ্ছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক দ্বারা এখনো বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানানো হয়নি এবারের এনআরসিতে নাম তোলার জন্য কী কী তথ্য লাগবে। আমাদের অপেক্ষা করতে হবে সরকারি নির্দেশের।
সুতরাং ক্রমানুযায়ী একবার রিপিট করা যাক লেখার বিষয়বস্তু। সিএএ ২০০৩ আইনে এনআরসি বা জাতীয় নাগরিক পঞ্জীর কথা রয়েছে। এনআরসির আগে এনআরপি বা জাতীয় জনসংখ্যা নিবন্ধন তৈরি হবে, যেখানে দেশের সমস্ত ব্যক্তির তথ্য নেওয়া হবে। তারপর সরকারি আধিকারিক দ্বারা নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে সন্দেহজনক ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে তাদের নোটিশ পাঠানো হবে সরকার নির্দিষ্ট তথ্যাদি জমা করে প্রমাণ করতে হবে সেই ব্যক্তি অথবা তার পূর্বপুরুষ ১৯৪৮ সালের ১৯ শে জুলাইয়ের আগে দেশে এসেছেন। এই সমস্ত নথি বিশ্লেষণ করে জাতীয় নাগরিক পঞ্জী প্রকাশ হবে। তাতে যাদের নাম বাদ যাবে, তাদের ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে আবেদন করতে হবে, যে তিনি বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের সংখ্যালঘু (হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি এবং খ্রিস্টান ধর্মের) এবং সেই দেশে ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হয়ে এদেশে আসার লিখিত প্রমাণ দেখাতে হবে। এই আবেদন করতে পারবেন ৩১৩১৩ জন। প্রমাণসমুহ ইন্টেলিজেন্স দ্বারা সেদেশে গিয়ে যাচাই করা হবে। এর পরেও যারা নাগরিকত্বের ছাড় পাবেন না, তাদের ঠিকানা ডিটেনশন ক্যাম্প।
প্রশ্ন আসে, এতকিছু করার কারণ কী? সরকারে থাকা লোকজন বলছে, "বহিরাগত", "অনুপ্রবেশকারী"দের দেশ থেকে তাড়িয়ে দিতে নাকি এই ব্যবস্থা করা হচ্ছে, যাতে সুযোগ সুবিধা শুধু দেশের লোক পায়, ইত্যাদি ইত্যাদি। সত্যিই কি তাই? এতদিনের যে নাগরিক কোনো কারণে নথি জোগাড় করতে পারেনি বা সব নথি দেওয়ার পরও যার নাম বাদ গেল এনআরসিতে, যাদের পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, এবং ভবিষ্যতে যাদের এরকম ঘটবে, তাদের দায় কে নেবে? নাকি শুধু সবটাই কর্পোরেট স্বার্থে সস্তা শ্রমিক তৈরির প্রক্রিয়া? এনআরসি, সিএএ ২০০৩ ও সিএএ ২০১৯ বিরোধী আন্দোলনকে তীব্রতর করতে হবে সাধারণ মানুষের স্বার্থে। যতদিন না এই জনবিরোধী আইনগুলো বাতিল হচ্ছে, ততদিন মানুষের মাথার ওপর নাগরিকত্ব হারানোর খাঁড়া খুলতেই থাকবে।
আশা করি, লেখাটি বিভ্রান্তি দূর করতে কাজে আসবে। লেখায় কোনো ভুল থাকলে অবশ্যই জানাবেন। লিখতে গিয়ে সাহায্য নিয়েছি অভিষেক দে দা, মাসিদুর রহমান দা, সব্যসাচী মুখার্জি দা এবং আরও অনেকের কাছে, প্রত্যেককে অবশ্য ধন্যবাদ।
তথ্যসূত্রঃ–
১)CA 1955 https://www.tiss.edu/uploads/files/Citizenship_Act_1955.pdf&ved=2ahUKEwiuufLsjNbzAhXSyzgGHX3WCQsQFnoECAYQAQ&usg=AOvVaw0OSVMwxaKaKRw0wliF9gO3)
২) CAA 2003 (https://egazette.nic.in/WriteReadData/2004/E_7_2011_119.pdf&ved=2ahUKEwiUhMC6jNbzAhXGfX0KHXb2AiMQFnoECAYQAQ&usg=AOvVaw3HEMnIPp6gTHP7YPkdiSAP)
৩) CAA 2019 (https://egazette.nic.in/WriteReadData/2019/214646.pdf&ved=2ahUKEwjJjtWFjNbzAhVEb30KHXjoDBIQFnoECAMQAQ&usg=AOvVaw0NLqZ7NbWW-sXe1LSfFMBl)
৪) Citizenship Rules, 2003 (https://drive.google.com/file/d/1GRr0YEJ5Ouj03GKJR5ZOR4ie9XoojHTq/view)
৫) Foreigners Act, 1946 (https://legislative.gov.in/sites/default/files/A1946-31.pdf&ved=2ahUKEwik6Or0jtbzAhU3wjgGHRFxClYQFnoECAoQAQ&usg=AOvVaw0lIoWd8Cd4aAVryywGGuuO)
৬) The Passport (Entry Into India) Act, 1920 (https://www.mha.gov.in/PDF_Other/act1920_17042017.pdf&ved=2ahUKEwict6e5j9bzAhVKWysKHUqNAYUQFnoECAcQAQ&usg=AOvVaw3b-xdEGxqKmLHMWolpMTgi)
Email — swarnavabhattacharya9@gmail.com
কবিতা:
দেরি
-প্রদীপ চক্রবর্তী
দুনিয়া চলে নিয়ম মেনেই
ভাগ্যের স্থান নেই,
নিজের উপর বিশ্বাস হারালে
ভয় চেপে বসবেই।
মানবধর্ম সেখায় যে প্রেম
তুমি-আমি একাকার,
যুক্তিবাদীরাই আসল ধার্মিক
দূর করে অনাচার।
আমরা সবাই হোমো স্যাপিয়েনস
রক্তের রং লাল,
আজকেই শোধরাও; করেছ যে ভুল
দেরি হয়ে যাবে কাল।
দুর্গা-কোরান
-অমিতাভ ভট্টাচার্য
একটা পুতুল একটা আরবি বই
ঠেকলে পরে কী ভীষণ হৈ চৈ!
রোজের জীবন এমনিতে জেরবার
"ধর্মতে হাত দিও না খবরদার ।"
পেট না ভরুক ধর্মরক্ষা হোক,
খরচা হবে খুচরো কিছু লোক ।
লাশের আবার জাতের বিচার চাই,
কে দুশমন কোনটা আমার ভাই?
একটা পুতুল একটা আরবি বই
ঠেকলে পরে কী ভীষণ হৈ চৈ!
রক্তখাকি ধর্মরা সব নাচে
ওপার তোমার, এপার আমার আছে ।
সীমান্ততে কঠিন কাঁটাতারে
ঘেন্নাকে কি ঠেকিয়ে রাখতে পারে?
দুগ্গি ঠাকুর এবং আল্লা মিঞা--
কোনটা ক্রিয়া কোনটা প্রতিক্রিয়া?
আসুন, এবার সূক্ষ্মবিচার হোক
খরচা হলো খুচরো কিছু লোক ।
একটা পুতুল একটা আরবি বই
ঠেকলে পরে কী ভীষণ হৈ চৈ!
এই যে তুমি মস্ত মুমিন, মুসলমানের ছেলে
-আখতারুজ্জামান আজাদ
"এই যে তুমি মস্ত মুমিন, মুসলমানের ছেলে;
বক্ষ ভাসাও, ফিলিস্তিনে খুনের খবর পেলে।
রোহিঙ্গাদের দুঃখে তুমি এমন কাঁদা কাঁদো;
ভাসাও পুরো আকাশ-পাতাল, ভাসাও তুমি চাঁদও!
অশ্রু তোমার তৈরি থাকে— স্বচ্ছ এবং তাজা;
হ্যাশের পরে লিখছ তুমি— বাঁচাও, বাঁচাও গাজা।
কোথায় থাকে অশ্রু তোমার— শুধোই নরম স্বরে,
তোমার-আমার বাংলাদেশে হিন্দু যখন মরে?
মালেক-খালেক মরলে পরে শক্ত তোমার চোয়াল;
যখন মরে নরেশ-পরেশ, শূন্য তোমার ওয়াল!
তখন তোমার ওয়ালজুড়ে পুষ্প এবং পাখি,
কেমন করে পারছ এমন— প্রশ্ন গেলাম রাখি।
তোমরা যারা দত্ত-কুমার, মৎস্য ঢাকো শাকে;
কবির লেখা পক্ষে গেলেই ভজন করো তাকে।
মুসলমানের নিন্দে করে লিখলে কোথাও কিছু;
তালির পরে দিচ্ছ তালি, নিচ্ছ কবির পিছু।
কিন্তু তোমার অশ্রু, আহা, কেবল তখন ঝরে;
বাংলাদেশের কোথাও কেবল হিন্দু যখন মরে!
পুড়লে তোমার মামার বাড়ি, জীবন গেলে কাকুর;
তখন তোমার কান্না শুনি— রক্ষে করো, ঠাকুর!
কালীর ডেরায় লাগলে আগুন তখন কেবল ডাকো,
রহিম-করিম মরলে তখন কোথায় তুমি থাকো?
বাংলাদেশে সুশীল তুমি, ভারতজুড়ে যম;
মুসলমানের মূল্য তখন গরুর চেয়ে কম!
বাংলাদেশের কস্তা-গোমেজ— যিশুর দলের লোক;
বোমায় ওড়ে গির্জা যখন, তখন কেবল শোক।
বস্তাভরা শোকের রঙে কস্তা তখন রাঙে,
যিশুর নামে মারলে মানুষ নিদ্রা কি আর ভাঙে!
মরণ হলে মুসলমানের, হয় না কাঁদার ইশু;
গভীর ঘুমে থাকেন তখন বাংলাদেশের যিশু!
খেলার ওপর চলছে খেলা— টমের সাথে জেরি;
বঙ্গদেশের সন্তানেরা এমন কেন, মেরি?
মুখের ওপর মুখোশ খুলে জবাব এবার দিয়ো।
রোহিঙ্গাদের রক্তে যখন বার্মা মরণ-কূপ;
বাংলাদেশের বৌদ্ধ যারা, মড়ার মতোন চুপ!
ভিক্ষু যখন বলছে হেঁকে— রোহিঙ্গাদের কাটো;
তখন কেন, হে বড়ুয়া, ওষ্ঠে কুলুপ আঁটো?
এমন করেই মরছে মানুষ ধর্ম নামের ছলে;
বাংলাদেশের বৌদ্ধ কাঁদে, বুদ্ধ যখন জ্বলে।
যখন জ্বলে বৌদ্ধবিহার, যখন রামুর পাহাড়;
সব বড়ুয়ার জবানজুড়ে শান্তিবাণীর বাহার!
শান্তিবাণীর এমন বাহার তখন কোথায় থাকে,
রোহিঙ্গারা যখন মরে নাফের জলের বাঁকে?
পাগড়ি দেখি, পৈতা দেখি, আকাশজুড়ে ফানুশ;
চতুর্দিকে চতুষ্পদী, হচ্ছি কজন মানুষ!
জগৎজুড়ে সৈয়দ কত, কত্ত গোমেজ-বসু;
খতম কজন করতে পারি মনের মাঝের পশু!
মরণখেলায় হারছে কে বা, জিতছে আবার কে রে;
মরছে মানুষ, দিনের শেষে যাচ্ছে মানুষ হেরে।
হারার-জেতার কষতে হিশেব মগজ খানিক লাগে,
একটুখানি মানুষ হোয়ো কফিন হওয়ার আগে।
রক্তখেলা অনেক হলো, সময় এবার থামার;
বিভেদ ভুলে বলুক সবে— সকল মানুষ আমার।
বন্ধ ঘরের দরজা ভাঙো, অন্ধ দু-চোখ খোলো;
মরছে কেন আমার মানুষ— আওয়াজ এবার তোলো।"
জ্যোতিষ শাস্ত্র ও দেশসেবা
-নির্মল
[দুই বন্ধু, একজন আরেকজনকে দেখে ডাকছে]
১ম বন্ধু :এই বন্ধু শোননা শোন শোন,
কি হলো, পালাস কেন!
আমি কি বাঘ না ভাল্লুক?
২য় বন্ধু :তুই বড্ড পিছনে লাগিস,
অবান্তর প্রশ্ন করা তোর অসুখ।
১ম বন্ধু : যাব্বাবা! প্রশ্ন ছাড়া নতুন কিছু জানা যায় নাকি!
বিনা প্রশ্নে অন্ধের মতো মেনে নিলে,
জীবনটা তো হয়ে যাবে ফাঁকি।
২য় বন্ধু :এটাই তো তোর দোষ।
ছাড় ধুর!
শুনিস নি শাস্ত্রে বলা আছে,
বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর।
সেই বিশ্বাসী তোর নাই।
১ম বন্ধু : তুই ঠিক বলেছিস ভাই,
অন্ধবিশ্বাস কিছুই আমার নাই।
শোননা, আজ নতুন কথা বলব।
প্রমিস করছি, পিছনে লাগবোনা তোর।
২য় বন্ধু : মনে থাকে যেন, করছিস প্রমিস।
১ম বন্ধু: একদম, আয় না একটু গল্প করি,
তোর জন্য একটা ভালো কথা আছে।
তোর সাথে দেখা হল ভাগ্যিস।
২য় : আমার জন্য ভালো কথা!
চল ওই গাছ তলাতেই বসি।
১ম: চল তাই চল।
[দুই বন্ধু গাছ তলাতে গিয়ে বসলো]
২য়: বল এবার কী বলবি বল?
১ ম: আমি এতদিন জ্যোতিষ নিয়ে তর্ক করে,
করেছি ভুল খুব
তুই আসলে সঠিক ছিলি,
আমিই বেয়াকুব।
তুই কি জানিস, বিজ্ঞান ইতিহাস ভূগোলের মত
জ্যোতিষশাস্ত্রও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হবে ;
জ্যোতিষ যদি ভুলিই হতো
সরকার কি এমন সিদ্ধান্ত নেয় তবে!
২য় : আবার তুই ঠাট্টা করছিস!
হেঁ হেঁ,
জ্যোতিষ শাস্ত্র সিলেবাসে -
ইম্পসিবল!
১ম : বিশ্বাস হচ্ছে না আমার কথা,
পেপারে দিয়েছে দেখ তবে;
এইবার থেকে ইগনু বিশ্ববিদ্যালয়ে
জ্যোতিষ নিয়ে বছর দুয়ের
মাস্টার ডিগ্রি করা যাবে।
২য় : বলিস কি !
দেখি দেখি,
এমন হয় নাকি !
সে কি!
১ ম: এমনি হয়েছে বন্ধু আমার।
২য় : তাহলে,
খুব তো জ্ঞান মারতি আমায়,
আদিম কুসংস্কার।
স্বার্থপর মানুষ ব্যবসা
সব জ্যোতিসি ভন্ড বলে,
বল বল এবার।
১ম : বললাম তো,
অন্যায় হয়েছে সরি
দেখ না!
কান ধরেছি দেখ,
২য় : থাক আর অভিনয় করতে হবে না,
তোর বিশ্বাস ফিরেছে,
এটাই অনেক।
বল তাহলে এরপর?
১ম : মাথায় একটা প্ল্যান আছে জব্বর।
দেখ তুই আর আমি ছাত্র ভালো।
ডিগ্রি কি আছে কম!?
ভাগ্য খারাপ, তাই বেকার বসে
চেষ্টা চলছে হরদম।
চল বন্ধু,
এবার জ্যোতিষ পড়ি,
ভাগ্য যাবে বদলে।
দেশে সেবার এই তো সুযোগ
হারাবি পায়ে ঠেললে।
২য় : অ্যাঁ! কি বলছিস যা্তা!
দেশসেবার সঙ্গে জ্যোতিষ, কি সম্পর্ক?
গেছে নাকি তোর মাথা।
১ম: আরে পাগল, আমার মাথা ঠিকই আছে।
একটু ভাবনা চিন্তা কর।
জ্যোতিষ পড়াচ্ছে কি এমনি এমনি,
সরকারের কোন দরকার!
দু'বছর পর দেখবি, কর্মক্ষেত্রে বড় বড় বিজ্ঞাপন -
অমুক বিভাগে মাস্টার ডিগ্রি জ্যোতিষ চাই।
এসসি ৩০, এসটি ১০, জেনারেল ৫০
মোট নব্বই জন।
সচিবপদ বিলুপ্ত হবে।
জ্যোতিষ হবে পরামর্শদাতা।
আরে পৌরাণিক যুগে যেমন হত।
জ্যোতিষীই শেষ কথা।
২য় : বন্ধু তোর অনেক ট্যালেন্ট,
আমি তাতো জানি।
কিন্তু,
জ্যোতিষশাস্ত্র পড়ার আগেই,
শুরু করে দিলি ভবিষ্যৎবাণী!
১ম : হ্যাঁ, তুইও শুরু কর প্র্যাকটিস।
২য় : আমায় ছাড়,
তুইই জ্যোতিষের চাকরি নিস।
১ম: সে তো নেবই,
তলার পর তলা হাঁকিয়ে বাড়ি বানাবো।
ইনকাম ট্যাক্সহীন কোটি কোটি টাকা কামাবো।
আর, বিদেশী সব গাড়ি তো আছেই,
নেতা মন্ত্রী পুলিশ উকিল সব পকেটে পুরে,
সারা জীবন কাটাব মহা রঙ্গে।
চিন্তা নেই প্রিয় বন্ধু।
প্রমিস করছি,
তোকেও নেব সঙ্গে।
২য় : ছাড়, ওসব ছ্যাবলামি ছাড়!
আসলে গল্পটা তোর খারাপ লাগছে না,
ওটাই শুধু বলনা ভালবেসে।
জ্যোতিষের সঙ্গে দেশসেবা
কোনখানেতে মেশে।
১ম : দেশসেবা!
শোন তবে,
জ্যোতিষের কিছু সাধারন ক্ষমতায় আসি।
ভুল যদি কিছু বলি
তবে তোকেই,
ধরিয়ে দিতে হবে।
২য় : ঠিক আছে বল তবে।
১ম : জ্যোতিষী তো আয়ু বলতে পারে
হাত দেখে বা কুষ্টি বিচার করে।
২য় : তাতো পারেই।
১ম: আবার দুর্ঘটনা বা মৃত্যুযোগও
কাটিয়ে দেওয়া যায়।
পাথর শেকর বেঁধে,
আঙুল, বাহু, মাজায়।
২য় : হ্যাঁ, তাও হয়।
১ম: আবার দেখি বিজ্ঞাপনে,
জ্যোতিষীরা সিদ্ধহস্ত শত্রু দমনে।
বানমারা বিদ্যারও জ্ঞান রয়েছে,
পটু সব বশীকরণে।
২য় : এসব তো পারেই,
আসল কথায় আয় না -
১ম : বলতো প্রতিবছর আমার দেশে,
শহীদ হয় কত বীর সেনা।
কত মা সন্তান হারায়,
কত নারী স্বামী,
কত সন্তান পিতৃহারা হয়,
যারা আমাদের রক্ষা করে ;
তাদের জীবনটা এত কমদামী!
এদের জীবন রক্ষা করতে চাই,
জ্যোতিষের ক্ষমতা দিয়ে।
সরকারেরও হয়তো সেই ইচ্ছে
উন্নত জ্যোতিষী তৈরি করবে,
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়ে।
২য় : মানে কি?
১ম : মানে অতি সহজ কথা,
প্রথমত, সেনা রিক্রুটমেন্ট বোর্ডে
থাকবে জ্যোতিষী পরামর্শদাতা।
হাত দেখে বা বিচার করে কুষ্টি
আয়ু তার কতদূর আছে দেখে,
তবেই নিযুক্ত করা হবে;
যদি জ্যোতিষীর হয় সন্তুষ্টি।
আয়ু যাদের কম আছে,
তারা প্রথমেই হবে রিজেক্ট,
মৃত্যুহার এমনিতেই কমবে,
রিক্রুটমেন্ট হবে পারফেক্ট।
২য় : কথায় তোর যুক্তি আছে,
বলে যা তারপর।
১ম : তারপর ধর যাদের আছে,
দুর্ঘটনা বা মৃত্যুযোগ,
অথবা যাদের উপর শনির দৃষ্টি,
ঘাড়ে চেপে রাহু কেতুর গুষ্টি,
তাদের ধরে -
নীলা গোমেদ ক্যাটসাই গুঁজে দেবে।
ব্যাস খেল খতম,
সবাই দুর্ঘটনা বা মৃত্যুযোগ থেকে রক্ষা পাবে।
শনি রাহু সব নিপাত যাবে,
শত্রু ছোড়া গুলি বোমা,
তখন অকেজো হবে।
বড়জোর থার্টি ডিগ্রী অ্যাঙ্গেলে,
কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাবে।
২য় : বাবা!
এরপরও কি আছে কোন প্ল্যান?
১ম: আর, শত্রু দমনের স্পেশালিষ্টদের,
বসিয়ে দেওয়া হবে বর্ডারের ধারে।
শত্রু সব বিনাশ করবে,
আধুনিক সব বাণ মেরে।
আর আনাচে-কানাচে যত আছে সব জঙ্গী,
যত আছে তাদের সঙ্গী,
এমন বশীকরণে বশ হবে সব যাতে;
ফ্রেন্ডশিপডে তে গোলাপ দেয় সব,
জনতার হাতে হাতে।
২য় :বন্ধু,
লজিক তোর পারফেক্ট আছে,
যতই করিস না ব্যাঙ্গার্থ।
জ্যোতিষের যখন এতই ক্ষমতা,
তখন এইসব তাদের পারা উচিত,
যাতে বাঁচবে জীবন, বাঁচবে দেশের অর্থ।
ধন্যবাদ বন্ধু,
এতদিন সত্যিই ছিলাম অন্ধ।
তোর লজিকেই কেটে গেল,
মনের সব দ্বন্দ্ব।
সত্যি, শিক্ষিত হলেই হয়না শুধু,
চাই যুক্তিবাদী মন,
যুক্তি দিয়ে বিচার করে
তবেই,
সত্যি-মিথ্যা করতে হয় গ্রহণ।
বুঝেছি এবার জ্যোতিষ শিক্ষা,
কেন চালু হল,
কি আসলে ওদের তাল,
দেশের মানুষকে বোকা বানিয়ে,
দেশটাকে লুটে পুটে খেয়ে,
পিছিয়ে দেবার চাল।
১ম : ধন্যবাদ তোকেও বন্ধু,
তুই এত সহজেই গ্রহণ করেছিস সত্যযুক্তি।
সমাজটাকে এগোতে চাই,
এই সমস্ত কুসংস্কার থেকে মুক্তি।
চল আজ ওঠা যাক তবে,
[হাতের আংটিগুলো খুলে বন্ধুর কাছে এগিয়ে দিয়ে]
২য় : সে নয় হল,
কিন্তু, এই সোনা বাঁধানো লালনীল পাথরগুলোর কি হবে,
এই বাঁধন গুলো বিক্রি করে চল,
কার্শিয়াং ঘুরতে যাই।
মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেব,
কুসংস্কারকে করে বাই বাই।
আইডিয়াটা কেমন বল ,
কি বলতে চাস?
১ম : চল তবে,
ডাকছে আকাশ ডাকছে বাতাস,
মুক্ত বাতাসে নেবই শ্বাস।
চেতনা পত্রিকার জন্য লেখা পাঠান yuktibadira@gmail.com এ। যুক্তির পথে আমরা। ধন্যবাদ।
Comentarios